স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু রাজনীতির প্রবাদপুরুষই নন; তিনি ছিলেন সত্যিকারার্থে একজন শিক্ষানুরাগী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিত্ব। বাঙালি জাতির ভাগ্যোন্নয়নে তিনি সারাজীবন নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন; করে গেছেন লড়াই-সংগ্রাম। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি যে সম্ভব নয়, তা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি স্বনির্ভর, শিক্ষিত, উন্নত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন আমৃতু্য। শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আপামর শিক্ষাব্যবস্থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে দেশকে উত্তরণের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা-উত্তর দেশ পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাতে তিনি শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে উলেস্নখ আছে- '১৭(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।'
বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে সব সময় ভেবেছেন। স্বাধীনতার পর ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিলেন তিনিই। শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈষম্যহীন ও যুগোপযোগী করার জন্য কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে শিক্ষার সঙ্গে গবেষণার বন্ধন তৈরি করা দরকার বলে বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সে দেশে পাঠিয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও গবেষণার অভিজ্ঞতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন, যার সুফল আজও আমাদের দেশ পাচ্ছে।
শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ও ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময়েও তিনি কার্যকরী সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে যেসব শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং এসব কমিশন যা সুপারিশ করেছিল তা ছিল ত্রম্নটিপূর্ণ। এজন্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছিল; ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে জনমুখী ও সম্প্রসারণ করতে কোনো কৃপণতা করেননি। সদ্য স্বাধীন এ নবীন রাষ্ট্রে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদাকে প্রধান করে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে এ কমিশন যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর ব্যাপক জোর দেওয়া হয়; এক কথায় এ রিপোর্ট ছিল পুরোটাই বিজ্ঞানমনস্ক। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আরও দুটি শিক্ষাবিষয়ক আইন প্রণীত হয়, তা হলো- মাদ্রাসা এডুকেশন অর্ডিনেন্স- ১৯৭২ এবং প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট- ১৯৭৪। এছাড়া ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন প্রণয়ন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কতটা শিক্ষানুরাগী ছিলেন তা তিনি স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই প্রমাণ করে দেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের ঘোষিত ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় শিক্ষা ও কৃষি খাতে। অর্থাৎ সে বছর প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৭% বরাদ্দ বেশি রাখা হয়। সে অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি টাকা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৪৩ কোটি টাকা। কারণ তিনি জানতেন প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভেঙেচুরে নিশ্চিহ্ন হওয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত লাখ লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুনর্গঠিত করেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় তিনি কারিগরি শিক্ষার ওপরও জোর দিয়েছিলেন। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে বিরল।
বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে বঙ্গবন্ধু দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাবিস্তার ও নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ। তিনি ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রম্নয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের একটি আইন প্রণয়ন করেন। এই আইন প্রণয়নের পর প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক বৈপস্নবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করে শিক্ষাকে সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া তার আমল থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হয়। বিতরণ হতো শিক্ষা উপকরণ খাতা, কলম, পেন্সিল, গুঁড়োদুধ, ছাতু, বিস্কুট পর্যন্ত। তিনিই প্রথম এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করেন।
১৯৭৩ সালে শূন্য কোষাগার নিয়েও বঙ্গবন্ধু দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারিকরণ, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে স্কুলড্রেস প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে মতামত জানতে চান। সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ মতামত পেশ করেন। এসব মতামতের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসন, সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে গণতান্ত্রিক মতামত রাখার সুযোগ প্রদান, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের বিষয়টি উঠে আসে। এসব প্রস্তাব পাওয়ার পর ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দ্রম্নত আইন জারি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সত্যিকারার্থে জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে; যা বঙ্গবন্ধুর উদার মানসিকতারই পরিচয় বহন করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনোত্তর এক ভাষণে তার শিক্ষা ভাবনা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। তিনি সে সময় শিক্ষা সম্বন্ধীয় যে প্রস্তাবনা পেশ করেন তা ছিল এরকম- ১. 'সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।' ২. 'নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।' ৩. 'দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।'
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি সব জায়গায় আধুনিক ও মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তবে আমূল পরিবর্তনটা তিনি এনেছিলেন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায়। উচ্চশিক্ষাকেও যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এসে দেশে উচ্চশিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং ধনী-গরিব বৈষম্য দূর করলেন এবং গঠন করলেন মঞ্জুরি কমিশন।
শিক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা, বিজ্ঞানের প্রতি যে একাগ্রতা ছিল, তার ধারাবাহিকতায় দেশে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শিক্ষা ও গবেষণায় জোর দিতে হবে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায় বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি কর্মমুখী শিক্ষার উন্নয়নে গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেছেন।
পরমাণু গবেষণার মাধ্যমে দেশ যাতে উপকৃত হয়, সেটি বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে ভেবেছেন। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে উন্নত গবেষণার ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি সোনার বাংলা গড়ার বিশ্বাসকে ধারণ করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। এর আগে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন গবেষক-বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীকে ভারতের পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণার উদ্দেশ্যে পাঠান। পরবর্তী সময়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকার সাভারে ২৬৫ একর জমি পরমাণু গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রদান করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণায় নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে (আইটিইউ) বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ তারই যোগ্য নেতৃত্বের ফসল। আইটিইউ স্যাটেলাইট অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিমালা তৈরি এবং এর বরাদ্দে সহযোগিতা দেওয়া ও সমন্বয়ের কাজ করে থাকে। এছাড়া তিনি রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধন করেন। এই উপগ্রহ কেন্দ্রের চিন্তাপ্রসূত আজকের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট; এর মধ্যদিয়েই বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের ভিত্তি রচিত হয়; সর্বোপরি ডিজিটাল বিপস্নবে সামিল হওয়ার পথ সুগম হয়।
ড. আবদুল আলীম তালুকদার : কলাম লেখক, শিক্ষক