পঞ্চাশের দশক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দূরদর্শী এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক কুশলী রাজনৈতিক নেতা। এ সময় শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী হন মুজিব। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। মুজিবের ৬ দফার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভীত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে শেখ মুজিবকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার সমস্ত জনগণ। জনরোষের কাছে নতি স্বীকার করে একপর্যায়ে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শোষকগোষ্ঠী। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেই উত্থাপিত হয় ১১ দফা দাবি- যার মধ্যে ছয় দফার সব দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। লাখো মানুষের এই জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুজিবের স্বায়ত্তশাসনের নীতির পুরোপুরি বিপক্ষে ছিল। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। শেখ মুজিব তখনই বুঝে যান যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে রাতের অন্ধকারে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা এবং শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড। অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে কোলের শিশু- কেউ রক্ষা পায়নি পাক হায়েনাদের নারকীয়তা থেকে। মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। অবশ্য তার আগেই, পাক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক আন্দোলনে শামিল হতে আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ সরকারের অধীনেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী এবং শুরু হয় পাকসেনাদের প্রতিহত করার পালা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর, ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে আসে বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেখানেই বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে; তার স্বপ্নের স্বাধীন দেশে। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনককে বরণ করতে লাখো মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে। দেশে ফিরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানান বঙ্গবন্ধু এবং খুব অল্পসময়ের মধ্যেই সাহায্য আসতে শুরু করে। শুরু হয় বাংলাদেশ পুনর্গঠনের এক নতুন যুদ্ধ। এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে ওঠেপড়ে লাগে এ চক্রটি। এ সময় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৭৪ সালে তিনি সব রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে আনতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা 'বাকশাল'। একই সঙ্গে অন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। উলেস্নখ্য, প্রথম যে দলটি নিষিদ্ধ করা হয় তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবের নিজের দল। এর ফলে দেশে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করে। সমস্ত দেশ যখন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই আসে আরেকটি আঘাত।
একটা নতুন দেশকে গঠন করা কত শক্ত কাজ তা বোঝা কঠিন। আদমজী পাটকল আর কর্ণফুলী পেপার মিলসকে সিকিউরিটি রেখে বাংলাদেশ প্রথম তার কারেন্সি ছাপিয়েছে ১৯৭২ সালে এবং পাকিস্তানের এক রুপির জায়গায় এক টাকা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত পথঘাট সব মেরামত করে সবকিছুই স্বাভাবিক করে এনেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং দেশীয় ষড়যন্ত্র মিলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সবকিছুই স্তব্ধ করে দিয়েছিল; না হয় এতদিনে বাংলাদেশের আরও অগ্রগতি হতো। প্রশাসক হিসেবে যারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে কথা বলেন তারা মিথ্যার আশ্রয় নেন। যুদ্ধ করে একটি জাতিকে স্বাধীন করেন যে নেতা, তিনি খারাপ প্রশাসক হন কী করে! পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অগ্রগামী সৈনিক হয়ে বঙ্গবন্ধু সেই পাকিস্তানে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে সেই দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। সেই লোক অদক্ষ প্রশাসক হলে, একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়া এবং সেই দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন কী করে সম্ভব! যারা বঙ্গবন্ধুকে দক্ষ শাসক নয় বলে প্রচারণা চালান, তারা বিষয়টা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক দক্ষতার মান। আন্তর্জাতিক বইপত্রে তাকে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আর আয়ারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট দে ভ্যালেরার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
\হশেখ হাসিনা উন্নয়নের নেত্রী। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন বলে দেশ আজ নিরাপদ। অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ। শুধু পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন নয়, দেশ আজ শতভাগ বিদু্যতায়ন হচ্ছে। তাছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইটি, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বহু শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠাসহ সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশ আজ অনেক দূর এগিয়েছে। এক সময় দেশকে নিয়ে মানুষ কৌতুক করত, উপহাস করত। আর বাস্তবতা ছিল প্রায় সে রকমই। ক্ষুধা-দারিদ্র্য জর্জরিত ছিল এ দেশের মানুষ। সেই অবস্থা বদলে গেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করছেন। শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং দেশের মানুষের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে পায়, উন্নত জীবনযাপনসহ মৌলিক-মানবিক চাহিদা নিশ্চিত হচ্ছে বলেই জনগণ শেখ হাসিনার সঙ্গে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আসলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, বাঙালি বীরের জাতি। আমরা যুদ্ধ করে দেশ অর্জন করেছি। যে জাতি জীবনের বিনিময়ে রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন করে, সেই জাতি কোনো দিনই পিছিয়ে থাকতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সার্থক প্রমাণিত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। আমাদের আর্থিক সক্ষমতা আছে বলেই নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয়বহুল পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন হচ্ছে- যা ছিল এক সময় রূপকথার গল্পের মতো। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রাথমিক যা ধরা হয়েছিল, তার থেকে তিনগুণ বেড়ে সর্বমোট ৩০,১৯৩ কোটি টাকায় এসেছে। যদিও নানা জটিলতা ও সময়ক্ষেপণ এবং মূল সেতুর নকশা বারবার পরিবর্তন করার কারণে এ ব্যয় বেড়েছে। সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি নদী শাসনের জন্য চায়না সিনোহাইড্রো করপোরেশন আর দুই সংযোগ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবুল মোমেন লিমিটেড। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর ভূমিকম্প সহনশীল এই সেতুটি বিশ্ব ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে থাকবে।
সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখন আইএমএফ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করেছে এ বছর বিশ্বে মাত্র ২৯টি দেশের ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, যার মধ্যে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় স্থানে অবস্থান করবে। শুরুতে রপ্তানি খাত হোঁচট খেলেও তাতে এখন গতি ফিরেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ৪২ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি- যা একটি নতুন রেকর্ড। ঘরের ও বাহিরের শত্রম্নর মুখে ছাই দিয়ে পদ্মা সেতুর উপর বসলো সর্বশেষ স্প্যান। অবাক বিস্ময়ে সারা দুনিয়ার মানুষ দেখল, যে দেশের ৩০ লাখ মানুষ নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন দিতে পারে সেই দেশ সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতুর মতো এমন সব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে, তাও আবার নিজস্ব অর্থায়নে। এর জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব। দেশ স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর সেই দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে করোনা মোকাবিলাসহ পদ্মা সেতুর মতো বড় চ্যালেঞ্জকেও সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্ব আর প্রশাসনিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।
আমরা আশা করি, সরকারের সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতা ২০৪১ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নত দেশের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। তাই পরিশেষে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে লালন করে শতাব্দী ইতিহাসে বাংলাদেশের নাম চিরস্মরণীয় ও চিরবরণীয় হয়ে থাকবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক