বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ : বাড়াতে হবে সচেতনতা

স্বাস্থ্যবিধি ও করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। আমাদের হতে হবে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল।
গোপাল অধিকারী
  ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

শীতকালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের করোনা জনজীবনে একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এ ভাইরাসটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতি ও শিক্ষা সব কিছুর ওপরই প্রভাব বিস্তার করেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত। আর বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। করোনা বাংলাদেশে জোরালো প্রভাব না ফেললেও পূর্ব সতর্কতা বর্তমান পরিসংখ্যানও লোপ করে দিতে পারত বলে মনে করেন অনেকে।

তাপমাত্রা ওঠানামার সঙ্গে ভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও নানা কারণে বাড়তে পারে সংক্রমণ, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাপমাত্রা কমলে বারবার স্নান করা বা ঘন ঘন কাপড় ধোয়ার প্রবণতা কমবে। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এ ছাড়া শীতে রোদ কম থাকলে শরীরে ভিটামিন 'ডি'-এর জোগান কমে যায়। ফলে কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। করোনার ভ্যাকসিন এখনো বাজারে আসেনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বিশ্বজুড়ে। ফলে সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। এ পরিস্থিতিতে শীতকাল কতটা উদ্বেগের হয়ে উঠতে পারে?

সমীকরণে দেখা যায় গত কয়েকদিনের ব্যবধানে করোনা সংক্রমণের ও মৃতু্যর পরিসংখ্যান বাড়ছে। করোনাভাইরাসের আরেকটি ধাক্কা আসছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, প্রথমবারের অভিজ্ঞতা দিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক থাকতেও বলেন তিনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানো সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন সরকারপ্রধান। গত রোববার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মাগুরা, যশোর ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি সেতু উদ্বোধনকালে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, মহামারির এ প্রকোপের মধ্যে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য।

ইতিমধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য সরকার ইতিমধ্যে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশও দিয়েছে। 'নো মাস্ক, নো সার্ভিস', অর্থাৎ মাস্ক না পরলে সেবা নেই এ প্রতিপাদ্য নিয়ে সরকার করোনাবিরোধী প্রচারণা চালাতে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য কোয়ারেন্টিনের আয়োজন করতে সারাদেশের সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা জোরদার করার কাজও শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কারণ, বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, এ পরিস্থিতি বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপে। সেখানে কোনো কোনো শহর বা অঞ্চলকে নতুন করে লকডাউন বা অবরুদ্ধ করা হচ্ছে।

কথায় বলে, ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়। তাই আমার মতে আগের ভুল আবার করলে সঠিক হবে না, বরং আগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেই সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে হবে। পুরো ঢাকাকে আগে নিরাপদ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। সঙ্গে যে সব জেলাতে সংক্রমণ বাড়বে সেই সব জেলাকে লকডাউনের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছি।

যে কোনো বিষয়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতা কখনো ক্ষতি করে না। সঙ্কটের সময়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজেকে ও আশপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাবান ও পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে বলা হয়েছে ডবিস্নউএইচওর নির্দেশনায়। এ ছাড়া মাংস ও ডিম অবশ্যই যথাযথ তাপে ও ভালোমতো রান্না করে খেতে বলা হয়েছে। হাঁচি ও কাশির সময় অবশ্যই হাত বা টিসু্য দিয়ে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে হবে। এরপর টিসু্য ফেলে দিতে হবে এবং অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে। যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার পর হাত ধুতে হবে। কোনো প্রাণীর যত্ন নিলে বা স্পর্শ করলে ও প্রাণিবর্জ্য ধরার পরও হাত ধুতে হবে। শরীরে যে কোনো সংক্রমণ এড়াতে রান্না ও খাওয়ার আগে এবং পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। নিজের পাশাপাশি অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়েছে ডবিস্নউএইচও। ব্যবহার করা টিসু্য খোলা ঝুড়ি বা ডাস্টবিনে না ফেলে ঢাকনা রয়েছে এমন ঝুড়িতে ফেলতে হবে। হাতে গস্নাভস না পরে বা নিজে সুরক্ষিত না থেকে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির মুখ ও দেহ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একইভাবে গবাদিপশু ও বন্যপশুকে ধরার আগেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। রান্নাঘরের কাজেও বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলছে। কাঁচা মাংস, সবজি, রান্না করা খাবার কাটার জন্য ভিন্ন চপিং বোর্ড ও ছুরি ব্যবহার করতে হবে। কাঁচা মাংস, সবজি ও রান্না করা খাবার হাতে ধরার আগে অবশ্যই প্রত্যেকবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। রোগে ভুগে মারা যাওয়া বা অসুস্থ প্রাণীর মাংস একেবারেই খাওয়া চলবে না। তবে রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকাতেও উপযুক্ত তাপে ও ভালোভাবে সিদ্ধ করা মাংস খেলে ঝুঁকি নেই। কাঁচা বাজারে গিয়ে কোনো প্রাণী ও প্রাণীর মাংস হাতে ধরলে দ্রম্নত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। কাঁচা বাজারে অবস্থানের সময় অযথা মুখে-চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাজের জায়গাটি দিনে অন্তত একবার হলেও পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পরিধেয়টি অবশ্যই প্রতিদিন বদল করতে হবে এবং ধুতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে হাতে গস্নাভস ব্যবহার করা ভালো। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কের মধ্যে ভ্রমণ বিষয়েও সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদি জ্বর-সর্দি অনুভূত হয়, তাহলে যে কোনো ভ্রমণ বাতিল করাই ভালো। পাশাপাশি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও ওষুধ খেতে হবে। জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এমন কারও সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি মাস্ক ব্যবহার করা হয়, তবে নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। একবার মাস্ক পরলে তা বারবার স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একবার মাস্ক ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হবে। মাস্ক ধরার পর হাত ধুয়ে নিতে হবে। যদি ভ্রমণের সময় অসুস্থ বোধ হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। এর আগে রোগের ইতিহাস থাকলে সেটাও চিকিৎসককে জানাতে হবে। যেখানে-সেখানে বা জনসমাগমের স্থানে থু-থু ফেলা যাবে না। অসুস্থ প্রাণী ধরা থেকে সতর্ক থাকতে হবে এই যে সতর্কতাগুলো আছে সেগুলোকে আবারও মেনে চলতে হবে। এ সচেতনতাগুলো মানতে জনগণকে বাধ্য করতে হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এককথায় অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে কঠোরভাবে।

স্বাস্থ্যবিধি ও করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। আমাদের হতে হবে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল।

জনসচেতনতা আমাদের তৈরি করতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। অবশ্যই করোনার তীব্রতা কমাতে সচেতনতা ও শুদ্ধি অভিযান বাড়াতে হবে।

গোপাল অধিকারী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে