বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মারি ও মড়কে কত মৃতু্য?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য কম মাশুল দিতে হচ্ছে না বিশ্বকে। ব্যাপক প্রাণহানি তো আছেই বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব স্থবির। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য চাকরি- সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ড. হারুন রশীদ
  ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

মারি ও মড়কে মৃতু্য যেন আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলছে করোনা মহামারিকাল। প্রতিদিনই প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বলা হচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউ আসছে শীতে। মৃতু্য ও সংক্রমণ দুটোই বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে হানা দিয়েছে ডেঙ্গু। মশাবাহিত রোগ হলেও ডেঙ্গুও প্রাণঘাতী। কয়েক বছর ধরে বেশ ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু। এ বছর যেন নতুন উদ্যমে এসেছে ডেঙ্গু। করোনার মধ্যেই ডেঙ্গুর হানা 'যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।' বলা যায় মারি ও মড়ক আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। কোথাও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আসি আসি করেও আসছে না। এদিকে সিটি করপোরেশন থেকে মশা নিধনে ব্যাপক তোড়জোড়ের কথা বলা হলেও মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

আরও উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ঢাকাসহ সারাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি ১০০ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর হাসপাতালে ৯৩ ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগে সাতজন ভর্তি রয়েছেন। দুঃখজনক হচ্ছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রনজিৎ দাস চৌহান নামের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক ছাত্র মারা গেছেন। গত রোববার (১৫ নভেম্বর) রাত ১টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃতু্য হয়। এ ধরনের মৃতু্য কিছুতেই কাম্য নয়।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য কম মাশুল দিতে হচ্ছে না। ব্যাপক প্রাণহানি তো আছেই বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব স্থবির। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য চাকরি- সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখনো স্বাভাবিক হয়নি সবকিছু। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে অনেকদিন ধরে। এইচএসরি মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। অটোপাস দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও অনেকটা অনিশ্চিত। বলা যায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে হয়ে গেছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খোলা হবে, সবকিছু কবে হবে স্বাভাবিক কেউ বলতে পারছেন না সেটি। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

গত বছরও দেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ২৬৬টি ডেঙ্গুজনিত মৃতু্যর প্রতিবেদনের মধ্যে ২৬৩টি ঘটনা পর্যালোচনা করে ১৬৪ জনের মৃতু্য ডেঙ্গুজনিত কারণে বলে নিশ্চিত করে। ২০১৯ সালে দেশে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৭ জন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে ২২৯ জন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। এ ছাড়া আক্রান্তরা পিঠ, দাঁত, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব করে। ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে আক্রান্তদের অবস্থার উন্নতি না হলে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার আগে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়ারও দরকার নেই। চিকিৎসকরা এ ক্ষেত্রে সচেতনতার কথাও বলেন। বিশেষ করে রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি, কিংবা শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। এডিস মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনের বেলায়ও ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উচিত।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মতো ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় অনেকটা নিজের হাতেই। বাসায় খোলা পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এ ছাড়া ফুলের টবে জমে থাকা পানি, টায়ারের খোল, ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা অথবা পানির চৌবাচ্চায় এ মশা নির্বিচারে বংশবিস্তার করে। এ সব জায়গায় যেন পানি জমতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বাসাবাড়িতে এডিশ মশা যেন আবাস গড়তে না পারে সে জন্য থাকতে হবে সতর্ক।

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ১০২ ডিগ্রি ও এর চেয়ে বেশি জ্বর, সঙ্গেই তীব্র মাথা ও শরীরব্যথা, বিশেষ করে হাড়ে, তীব্র পেটব্যথা, স্কিনর্ যাশ ইত্যাদির সঙ্গে বমিভাব ও ক্ষুদামন্দা থাকলে তার ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এ অবস্থায় অনেকে আতঙ্কিত হয়ে এন্টিবায়োটিকসহ নানান ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর প্রশমনে কেবল প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পানি খেলেই চলে। তবে অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে। চিকিৎসকরা এমনটিই বলছেন।

বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের প্রধান হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত এক দশকে প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগই অর্থাৎ ২৫০ কোটি লোক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ৭০ ভাগই এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু, সতর্ক করে দিয়েছে, এখনই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

মারি ও মড়ক থেকে বাঁচতে হলে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। করোনা মহামারিতে প্রাণহানি বাড়ছে। এখনো আক্রান্তরের সংখ্যা বাড়ছেই। কিন্তু বাড়ছে না সচেতনতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই নেই। মাস্ক পরতেও অনীহা। বিশেষ করে শপিংমল, গণপরিবহণ এবং জনবহুল স্থানে মাস্ক পরাটা অত্যন্ত জরুরি হলেও অনেকেই তা মানছেন না। এ অবস্থায় 'নো মাস্ক নো সার্ভিস' স্স্নোগানকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। লোকজনকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে প্রয়োজনে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য কম মাশুল দিতে হচ্ছে না বিশ্বকে। ব্যাপক প্রাণহানি তো আছেই বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব স্থবির। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য চাকরি- সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এখনো স্বাভাবিক হয়নি সবকিছু। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে অনেকদিন ধরে। এইচএসরি মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। অটোপাস দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও অনেকটা অনিশ্চিত। বলা যায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে হয়ে গেছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খোলা হবে, সবকিছু কবে হবে স্বাভাবিক কেউ বলতে পারছেন না সেটি। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অন্যদিকে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুও মহাতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে যাতে এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মানুষজনকে সচেতন করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

করোনা মহামারি এবং ডেঙ্গু-দুই ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য।

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট

যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে