শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের নীরব কূটনীতির তাক লাগানো সাফল্য

পশ্চিমা দেশগুলোর আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার তোড়জোড়ের প্রেক্ষাপটে টানাপড়েনের সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে ১৯৯৬ সালে চীন ও রাশিয়া কৌশলগত অংশীদার (স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার) হয়েছে। এটাও সম্ভব হয়েছে চীনের সফল কূটনীতির ফলে। বিশ্বে চীনের প্রভাব ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেরেশান হলেও চীনের নীরবে প্রভাব বিস্তার এখন বাস্তবতা।
জহির চৌধুরী
  ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

এতদিন বিশ্ব চীনের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখেছে, এবার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও চীনের তাক লাগানো সাফল্য বিশ্ব দেখলো। চীনের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় গত ১৫ নভেম্বর আসিয়ান জোটভুক্ত ১০টি দেশসহ আসিয়ান জোটের বাইরের (চীনসহ) ৫টি দেশের মধ্যে 'দ্য কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ' বা 'আরসিইপি' নামের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ চুক্তি বিশ্বের বৃহৎ মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, এ চুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মেক্সিকো বাণিজ্য চুক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে, এ চুক্তির ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল গড়ে উঠবে। এ চুক্তিকে 'চায়না অভু্যত্থান' আখ্যায়িত করে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এ চুক্তির ফলে ভবিষ্যতে চীন এশিয়ার বাণিজ্য নীতি ও শর্ত নির্ধারণের সক্ষমতা অর্জন করবে। 'আরসিইপি' চুক্তি বিশ্লেষণ করলে চীনের কূটনৈতিক পরিক্বতা লক্ষ্য করা যায়। আসিয়ান জোটভুক্ত এবং আসিয়ান জোটের বাইরের যে দেশগুলো আরসিইপি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে সে দেশগুলোর কয়েকটির সঙ্গে চীনের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধসহ নানা বিষয়ে বিরোধ রয়েছে। এ সব বিরোধকে কেন্দ্র করে দেশগুলোর চীনের সঙ্গে তিক্ততা, এ দেশগুলোর কয়েকটির সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত দেশ আমেরিকার হরিহর আত্মার সম্পর্ক সত্ত্বেও চুক্তিটি সম্পাদন সম্ভব হয়েছে। আরসিইপি চুক্তি চীনের কূটনৈতিক ক্যারিশমার ফসল বলা যায় নির্দ্বিধায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কূটনীতিতে চীনের সাফল্যকে দেশটির কূটনীতির জাদুকরী ক্ষমতার ফল বলা চলে। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ইরানের সঙ্গে চীনের ২৫ বছরমেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর আলাপ-আলোচনা, দর কষাকষির পর চীন ও ইরান এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিকে একবিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক চুক্তি আখ্যায়িত করেছেন ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বে চলমান ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের মেরুকরণ প্রক্রিয়ার আলোকে ধারণা করা যায়, চীন ও ইরানের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বিশ্বে নতুন ভূ-রাজনৈতিক খেলা শুরুর বার্তা দিচ্ছে, এ চুক্তি শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, পুরো প্রাচ্যে প্রভাব ফেলবে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশ্বে খ্যাতিমান কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেছেন, এ চুক্তি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা পরিচিত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা 'সিআইএ'র জন্য বড় আঘাত। সিআইএ-এর মতো একটি সংগঠন, যাদের রয়েছে হাজার হাজার বিশ্লেষক, তারা এ ভূ-রাজনৈতিক চুক্তির বিষয়টি পূর্বানুমান পর্যন্ত করতে পারেনি, যা তাদের ব্যর্থতা। চীন-ইরানের ২৫ বছরমেয়াদি চুক্তি এবং আরসিইপি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে কমবেশি তিন মাস সময়ের মধ্যে। চীন মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে এমন দুটি চুক্তি সম্পাদন করাতে সক্ষম হয়ে তাদের কূটনৈতিক সক্ষমতার শক্তিই বিশ্বকে দেখিয়েছে।

চীনের নীরব কূটনীতির কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হম্বিতম্বির কূটনীতি হালে পানি না পাওয়া অনেকটাই প্রকটিত। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকার প্যাসিফিক পাইভট স্ট্র্যাটেজি (পিপিএস) অনেক আগেই কার্যত বস্ন্যাকহোলে চলে গেছে। 'পিপিএস'কে বিস্তৃত রূপ দেওয়া-নেওয়ার উদ্যোগও মাঠে মারা গেছে বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বারাক ওবামা ২০১২ সালে পিপিএসকে বিস্তৃত রূপ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিটিপি) গঠন করেন। 'টিটিপি'ও শেষতক হিমঘরে চলে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এশীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ন্যাটো সামরিক জোটের আদলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) নামে একটি জোট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ জোটকে এশিয়ার ন্যাটো মনে করা হচ্ছে। এ জোটে এশিয়ার দেশগুলোকে ভেড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আদাজল খেয়ে নেমেও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে মনে হচ্ছে না। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বাগান গত অক্টোবর মাসে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে অংশীদার করার মিশন নিয়ে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কয়েকটি দেশ সফর করে গেছেন। তার মিশন খুব একটা সফল হয়েছে বলা যাবে না। বাস্তবতা এটাই বলে, চীনের প্রভাব ঠেকানোর আমেরিকা নানামুখী প্রচেষ্টা, দৌড়-ঝাঁপ তেমন একটা ফল বয়ে আনছে না। আমেরিকার উদ্যোগে আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ (কোয়াড) নামে একটি জোট গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি। এ জোটও আমেরিকার প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। গত অক্টোবর মাসে আমেরিকার উদ্যোগে এ জোটের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে জাপানের রাজধানী টোকিওতে। বৈঠকে কোয়াড জোটভুক্ত চার দেশ একমত হতে পারেনি। বৈঠক শেষে চারদেশ আলাদা আলাদা বিবৃতি দিয়েছে, যা দেশগুলোর মতপার্থক্য চাউর করেছে। চীনের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকার একের পর এক নেওয়া উদ্যোগগুলো যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে তাতে আমেরিকার প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে হতাশ তা সহজেই অনুমেয়।

বিভিন্ন ঘটনা প্রমাণ করে বিশ্ব নেতাদের বড় অংশই চীনের ওপর আস্থাশীল হয়ে উঠছে। গত বছর ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করেছে। এতে কাশ্মীরের প্রো ইন্ডিয়ান পরিচিত নেতারাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ওই সব নেতাদের অন্যতম ধরা হয় কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুলস্নাকে। এ নেতা সম্প্রতি বলেছেন, 'চীন হস্তক্ষেপ করলেই জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা ফিরে পাবে।' এ মন্তব্যে কাশ্মীরীদের প্রতি ভারত সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে চীনের হস্তক্ষেপে মুক্তির আশাই প্রকারান্তরে ব্যক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র মোড়লগিরি প্রতিষ্ঠিত হয়। চীন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র মোড়লগিরি অবসানের চেষ্টায়ও বহুলাংশে সফল হয়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনায় মার্কিন সরকারের ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে ভবিষ্যতে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতের কথায় অনুমান করা যায় মধ্যপ্রাচ্যে চীনকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতে কিছু করা কঠিন হবে। ১৯ শতকের পর থেকেই ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচেটিয়া আধিপত্য করছে। ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলেও চীন ঢুকে পড়েছে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রচারণা আছে, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প গোটা বিশ্বকে চীনা বলয়ে আনার ফন্দিফিকির। এ প্রচারণা সত্ত্বেও চীন এ প্রকল্প জোরকদমে এগিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প (ওবিওআর) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্ব নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ২০১৭ সালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে দুদিনের এক সম্মেলন আয়োজন করেছিল চীন। ওই সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিনসহ বিশ্বের ২৯টি দেশের সরকার প্রধান এবং বিশ্বের ১৩০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে চীনের এ প্রকল্পকে রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোর সমর্থন দিয়েছে। সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, রাশিয়া ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পকে শুধু সমর্থনই করছে না, রাশিয়া অবশ্যই চীন ও আগ্রহী অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে।

পশ্চিমা দেশগুলোর আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার তোড়জোড়ের প্রেক্ষাপটে টানাপড়েনের সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে ১৯৯৬ সালে চীন ও রাশিয়া কৌশলগত অংশীদার (স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার) হয়েছে। এটাও সম্ভব হয়েছে চীনের সফল কূটনীতির ফলে। বিশ্বে চীনের প্রভাব ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেরেশান হলেও চীনের নীরবে প্রভাব বিস্তার এখন বাস্তবতা।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে নিজেদের মুদ্রা ঝুড়িতে অন্তর্ভুক্ত করে চীনা মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রার স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের বহুদেশ এখন মার্কিন ডলারের বদলে চীনা মুদ্রা ব্যবহার করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের দুয়ারে ধরনা দিতে হয়েছে। চীন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোকে চীন দুহাতে ঋণ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের দুয়ারে ঘোরাঘুরির প্রয়োজন ফুরিয়ে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের বেশির ভাগই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্ব দেওয়া; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো চলতে আগের মতো রাজি না হওয়া কারোরই দৃষ্টির বাইরে নেই। বাস্তবতা এটাই যে, চীন ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে, চীনের কূটনৈতিক সাফল্যে বিশ্বব্যবস্থাপনা নতুনভাবে সাজছে। চীনের কূটনৈতিক সাফল্য আরও কত চমক বিশ্বকে দেখাবে তা সময়ই বলে দেবে। চীনের নীরব কূটনীতির একের পর এক তাক লাগানো সাফল্য রূপকথার গল্পকেও হার মানাচ্ছে।

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

পযড়ফিযঁৎুুধযরৎ@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে