শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা

জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা আইন বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে আমাদের দেশের মানুষ বর্তমানে ঘরে অবস্থান করেছে। এবং দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ পরিবার। আর গত মার্চ মাস থেকে পারিবারিক সহিংসতার হার দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা মহামারিতে বিগত ৮ মাসে সমগ্র দেশে পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী ও ৩১ শতাংশ শিশু [সূত্র: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন)। এবং ৪০% পরিবারে পূর্বে কখনো পারিবারিক সহিংসতার মতো সমস্যা দেখা দেইনি। এক জরিপ মতে, পরিবারের সদস্য কিংবা নিকটাত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয় ও ৪১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ১০০৮ জন শিশু এবং আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ৩২৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অন্য একটি পরিসংখ্যান মতে, ৮০% ধর্ষক ভুক্তভোগীর পরিচিত। করোনার কারণে যে সব বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে তার মধ্যে একটি সমস্যা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব। দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আর্থিক দীনতা, বেকারত্ব, চাকরির অনিশ্চয়তা এমনকি মাদকাসক্তির মতো কারণে মানুষ চরম মানসিক বিপর্যয়ের স্বীকার হচ্ছে। যা মনে প্রতিনিয়ত রাগ, হতাশা ও পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করছে। আগে যে পরিমাণ অর্থে পরিবার পরিচালিত হতো, মহামারির কারণে পরিবারে অর্থের জোগান কমে এসেছে এবং অনেক পরিবারের অর্থসংস্থানই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই পরিবারের সবার ওপর এটা গুরুতর চাপ সৃষ্টি হয়েছে যা সদস্যদের একে অন্যের প্রতি মনোমালিন্য ও বিরূপ ধারণার জন্ম দিচ্ছে। অর্থাৎ বেকারত্ব, চাকরিচু্যত হওয়া, সামাজিক দূরত্ব এবং দরিদ্রতার কারণেই বর্তমান পারিবারিক সহিংসতার পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পুরুষ সদস্যের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পরিবারের তুলনামূলক দুর্বল সদস্য যেমন- স্ত্রী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ পিতা-মাতা ভোগ করছে। নারীর যাবতীয় সাংসারিক কাজের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান পারিবারিক সমস্যার ফলে নারী ও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত খারাপ হয়ে পড়ছে, অবশেষে যা আত্মহত্যায়ও রূপ নিতে পারে। সারাদেশে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ সৃষ্টি হচ্ছে। সহিংসতার ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়, বরং এটা হাজার বছরের লালন করা মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ই কোভিড-১৯ এর কারণে বিপর্যস্ত, সেখানে শুধু নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্য তার হতাশা, রাগ, আক্ষেপের কারণে নারীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করছে, অন্যপক্ষে একজন নারীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না। এমনকি যে সব পরিবারে নারী অর্থের জোগানদাতা ছিল, সে সব পরিবারেও বর্তমানে অর্থের জোগান দিতে না পারায় নারী বিরূপ সহিংসতার স্বীকার হচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার নারী ও শিশু পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন,২০১০-এর মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারে। এ আইনে বলা আছে, পারিবারিক সম্পর্ক আছে এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অন্য কোনো নারী বা শিশু সদস্য শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন কিংবা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলে এ ধারার অধীনে উক্ত নারী বা শিশু আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। এ ছাড়া দ্য পেনাল কোড ১৮৬০, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইন ১৯৮৫ উলেস্নখযোগ্য।

মূলত, নারী-পুরুষের প্রতি আচরণ, অধিকার ও ক্ষমতায়নের পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। এ কারণে এ ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকবে। পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার নারীর পক্ষে আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় এবং ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে আইনের আশ্রয় নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। লকডাউনের কারণে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। তাই দিনদিন এ সমস্যা আরও বেড়ে চলেছে।

দীর্ঘদিন অস্বাভাবিক জীবনব্যবস্থার ফলে সবার মধ্যেই মানসিক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তাই পরিবারে সবার সঙ্গে সমান ও সহানুভূতিশীল আচরণ এ ধরনের সমস্যা অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। আমরা নিজে ও আশপাশের সবাইকে পারবারিক সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা কমাতে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে পারি। তার সঙ্গে পরিবারের সব সদস্যদের নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সমআচরণ করার মনোভাব গড়ে তুলতে পারি। বাংলাদেশ সরকারের হেল্পলাইন ব্যবস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করতে হবে, যেন টেক্সট মেসেজ ও ফোন কলের মাধ্যমে সহজেই এ ধরনের সমস্যা প্রতিকার, প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের আশ্রয় প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি থানা, মহিলা কর্মকর্তা, জেলা লিগাল এইডসহ এ বিষয়ক সব প্রতিষ্ঠানকে পারিবারিক সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা ও সুষ্ঠু প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হওয়া জরুরি।

ভবিষ্যতে সহিংসতা এড়াতে নারী-পুরুষের মধ্যকার তারতম্য দূর করার ব্যাপারে শিশুদের পারিবারিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। ফলে শুধু সহিংসতাই থামবে না, বরং অনেক জীবন বাঁচবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে