শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু পর্নোগ্রাফি : আমরা কতটা সতর্ক?

বর্তমান সরকার যদি এই কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে পারে তাহলে দেশকে এই অন্ধকার দিক থেকে মুক্ত করে নতুন প্রজন্মকে একটি আলোর পথ দেখানো সম্ভব হবে।
অলোক আচার্য
  ২১ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

প্রযুক্তি এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা যেমন সুবিধা পাচ্ছি আবার বিভিন্ন সময় ক্ষতির সম্মুখীনও হতে হচ্ছে অনেককে। নানা চক্র ফাঁদ পেতে বসে আছে। কেউ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে টাকা কামাচ্ছে আবার কিশোরী বা তরুণীরা পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। চাইল্ড পর্নোগ্রাফি একটি আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব চাইল্ড পর্নোগ্রাফির গ্রম্নপের সদস্যরা ফাঁদ পেতে বসে আছে। গণমাধ্যম থেকে আরও জানা যায়, ইনস্টাগ্রামে চাইল্ড পর্নো গ্রম্নপগুলো 'শটআউট' নামে পরিচিত। এসব গ্রম্নপ থেকেই মোটিভেটেড করার কৌশল শিখে কিশোরীদের নগ্ন ছবি সংগ্রহ করে ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এসব চক্রের সদস্যদের ধরতে সারা বিশ্বেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সচেষ্ট রয়েছে। ইন্টারনেট জ্ঞানের এক বিশাল দুনিয়া যেখানে শিশু-কিশোর অনায়াসে প্রবেশ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। জ্ঞানের বিশাল জগতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে এর চেয়ে উপযুক্ত প্রযুক্তি আর নেই। আজকাল হাতে হাতে এন্ড্রয়েট ফোন আর ইন্টারনেট। আমাদের তো এর থেকে দূরে থাকার উপায়ও নেই। ফলে ভালোর সঙ্গে সঙ্গে ভুলবশত কোনো ফাঁদ কোনো চক্রের শিকারে পরিণত হচ্ছে। তা না জেনেই বা না বুঝেই হচ্ছে। ইন্টারনেটে নিজেকে নেতিবাচক দুনিয়ার সঙ্গেও পরিচিত করাতে পারে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের ওপর। সোজা কথায় আমাদের শিশু-কিশোরদের সামনে দুটো রাস্তা। একটা ভালোর দিকে। যেখানে শুধুই জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার। অন্যটা হলো খারাপ। যেখানে নিজেকে ধ্বংস করার প্রস্তুতি নেয়া যায়। কে কোনদিকে যাবে সেটা তার ইচ্ছা।

প্রলোভনের ফাঁদে পা দেওয়ার বয়সও তো এটাই। ভুল করার বয়সও এটা। তাই চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন দেশের কিশোরীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যারা কলেজে যায় তারা কিশোর। এই বয়স আগ্রহের বয়স। আবার ভুল করারও বয়স। যেখানে তাদের ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হলেও আবেগ নিয়ন্ত্রণের সময় হয় না। তারা বন্ধুদের সাহায্যে হোক, কৌতূহল বশত হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক পর্নো সাইট বা খারাপ সাইটগুলোতে প্রবেশ করছে। প্রবেশ করার কারণও খুব সোজা। নিষিদ্ধ জগতের দিকে প্রবল আগ্রহ আমাদের সহজাত। এসব জগতে একবার প্রবেশ করলে তা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। এটাও এক ধরনের নেশার মতো। যা একজন শিশু-কিশোরের মনোজগতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ধ্বংস করে দেয় সৎ চিন্তাগুলোকে। বারবার টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারের দিকে। ভালো করার আগ্রহ তার মধ্যে থেকে কমতে থাকে এবং তার আত্মবিশ্বাস অতিমাত্রায় নেমে যায়। ইন্টারনেটের যে বিশাল ভালো একটি দিক রয়েছে তা তার কাছে অজানা থেকে যায়। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে, বাড়িতে পড়ার ফাঁকে যে কোনো সময় সুযোগ পেলেই খারাপ সাইটগুলোতেই ঢুকছে। অনেক দেশেই পর্নো সাইটগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশু-কিশোরদের মুক্ত রাখতে পর্নো সাইটগুলো নিষিদ্ধ করেছে সে দেশের সরকার। আমাদের দেশেও অনেক পর্নো সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর আগেও এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আসলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন ওয়েবসাইটগুলোর সবই বন্ধ করে দেয়া উচিত।

পর্নো সাইটগুলো ক্রমেই ঘুণপোকার মতো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিঃশেষ করে ফেলছে। স্মার্টফোন এখন শিশু-কিশোরের নাগালেই থাকে। আর নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়া একটা শিশু অনায়াসেই স্মার্টফোন হাতে পায়। সেই সঙ্গে ইন্টারনেট সুবিধা। এই দুটো পাওয়ার পর তারা প্রথমেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। তারা বিভিন্ন গ্রম্নপে যোগ দেয়। তারা বেশির ভাগ সময়ই বুঝতেও পারে না কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। কারণ প্রথমে চক্রের সদস্যরা অভিনয় করে। একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারপর এক সময় তাদের প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ততক্ষণে ফাঁদে আটকা পড়ে অভাগা কিশোরী-তরুণীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এই চক্রের সদস্য ধরাও পড়েছে। অনেক সময় কিশোরী-তরুণীরা হঠাৎ বিখ্যাত হওয়ার জন্যও বিভিন্ন বিতর্কিত অ্যাপসে প্রবেশ করছে। এটা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং আমাদের সংস্কৃতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বাড়তে বাড়তে আজ এই হারে এসে পৌঁছেছে এবং এখনই না থামাতে পারলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আসলে আমাদের শিশু-কিশোররা সুস্থ যৌন শিক্ষার বিপরীতে একটি অসুস্থ এবং বিকৃত যৌন রুচির পরিচয় পাচ্ছে। যা পাওয়ার জন্য এসব শিক্ষার্থীদের খুব কষ্ট করতে হচ্ছে না। হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা সস্তা, দামি প্রায় সব মোবাইলেই রয়েছে ইন্টারনেট সুবিধা। আর এই সুযোগের অপব্যবহার করে নিজের মনের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। আমাদের হাতের নাগালে প্রাপ্য এসব ডিভাইসে ইচ্ছা করলেই ইন্টারনেটে ঢুকে যে কোনো সময় এসব অশ্লীল ভিডিও চিত্র দেখতে পারে, সেগুলো নেট থেকে নামাতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে দেখার জন্য সংরক্ষণ করতে পারে।

স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মনোজগত হয় আবেগ প্রবণ। এদের মনের অংশটাই জটিল। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টসাধ্য। এসব শিক্ষার্থীর মনে থাকে অগাধ কৌতূহল। আর কোনোভাবে একবার এ চক্রে প্রবেশ করলে তা এক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। লেখাপড়ার ব্যাগে, অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে বিদ্যালয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে আসে অনেক শিক্ষার্থী। তারপর তার অপব্যবহার করে। এটা আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। আমাদের দেশের অনেক অভিভাবক আছেন যারা সন্তানদের খোঁজ-খবর নেন না। শুধু সেমিস্টার শেষে ফলাফলের খোঁজ নিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমার সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেলামেশা করে, লেখাপড়ায় সত্যিকারের মনোযোগ কতটুকু ইত্যাদি বিষয় নিয়মিত এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কারণ সন্তান আপনার তাই দায়িত্বে পুরোটাই আপনার। সন্তান যদি ভালো কিছু করে তার পেছনে যেমন আপনার নাম বলা হয় ঠিক তেমন ভাবেই খারাপ কিছু করলেও আপনাকেই কথা শুনতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হলেই সন্তানকে মোবাইল কিনে দেয়। সে ক্ষেত্রে অভিভাবক সন্তানের প্রতি তার আবেগের বিষয়টি সামনে তুলে আনেন। কিন্তু সেই মোবাইল তার সন্তানের জন্য আদৌ কোনো দরকারি বস্তু কি না তা একবারও যাচাই করেন না। হয়তো সন্তানের প্রতি অতি মমত্ববোধ থেকেই এটা করেন। কিন্তু তাদের খেয়াল রাখতে হবে তার কিনে দেওয়া মোবাইলটা সে কীভাবে ব্যবহার করছে। আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। এটা সন্তানদের কাছ থেকে অভিভাবকের দূরত্ব বাড়ার কারণেও হতে পারে। সুতরাং সন্তানকে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। দূরত্ব তৈরি করে নয় বরং ভালোবেসে কাছে টেনে এ কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি

\হবর্তমান সরকার যদি এই কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে পারে তাহলে দেশকে এই অন্ধকার দিক থেকে মুক্ত করে নতুন প্রজন্মকে একটি আলোর পথ দেখানো সম্ভব হবে।

অলোক আচার্য :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে