বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হঠাৎ রাজপথে অগ্নিসংযোগ কেন?

সরকারের মারমুখী হওয়ার দরকার নেই। তবে নিরন্তর সতর্কতা ও যথা সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রশ্নে কোনো শিথিলতা কাম্য নয়। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়; হত্যা, কু্য ও ষড়যন্ত্র যাদের রাজনীতির অবলম্বন, বারবার তারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাবে এটাই স্বাভাবিক। আইনের শাসনের ধারায় এদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় পদক্ষেপ বাঞ্ছনীয়।
ডা. এস এ মালেক
  ২১ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

হঠাৎ ঢাকার রাজপথে আবার গণপরিবহণে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য কোনো মানুষ মারা যাননি ও গুরুত্বরভাবে আহতও হননি। তাই মনে হয়, যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকেই লক্ষ্য রেখেছেন, যাতে প্রাণহানি না ঘটে। জনগণ যেন বিক্ষুব্ধ না হয়। আঘাতটা সরকারের বিরুদ্ধে; জনগণের বিরুদ্ধে নয়। আসলে বাস্তবতাটা কি? একবার ভেবে দেখুনতো, বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত শিবিরের সহিংস আন্দোলনের কারণে এ দেশে কতজনকে জীবন দিতে হয়েছে। কত হাজার যানবাহন ভস্মিভূত অথবা বিধ্বস্ত করা হয়েছে। কোনো সুস্থ বিরোধী দল রাষ্ট্র বা জনগণের সম্পত্তির ওপর এরূপ ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে কি? তারপর একটা পর্যায় যখন বিরোধী দল (বিএনপি) দেখতে পেল ওসব করে কোনো লাভ নেই। তখন জামায়াত প্রদর্শিত ধ্বংসাত্মক পথে কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকারে যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, প্রতিপক্ষ সরকারি দল যার প্রধান জাতির পিতার কন্যা এবং যে দলে রয়েছে অগণিত ত্যাগী সমর্থক। যে দল প্রায় একযুগ টানা ক্ষমতায় থেকে দেশের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে। উন্নয়নের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। দারিদ্র্য সীমার নিচে এখন বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। শিশু মৃতু্যর হার নিম্নমুখী, মাথাপিছু গড় আয় কয়েকগুণ বেড়েছে, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (রেমিট্যান্স) বিশ্বের ১০টি শ্রেষ্ঠ দেশের তালিকায়। গরীব-দুঃখী মানুষের কল্যাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন আর মঙ্গার কথা শোনা যায় না। প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষের ঘরে বিদু্যৎ পৌঁছে গেছে। ভয়াবহ বৈশ্বিক মহাদুর্যোগ করোনা যেভাবে সরকার মোকাবিলা করেছেন তা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা অনেক কম। করোনার মরণ থাবা অর্থনীতি লন্ডভন্ড হলেও বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। ১২ বছর উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক ও উন্নয়ন সহযোগী দাতাগোষ্ঠী এ বছরে প্রবৃদ্ধির হার মারাত্মকভাবে কমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তাদের সেই ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। যদিও এ বছরের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানি, তবুও সন্তোষজনক ছিল। করোনার আঘাতে অর্থনীতির চাকা যেখানে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সরকারের দুর্যোগকালীন গৃহীত নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও সঠিক দিকনির্দেশনায় উন্নয়নের গতিধারা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। এ কারণে অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি আজ স্থিতিশিল আছে। এক্ষেত্রে সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এর কৃতিত্ব সরকারের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনাকালীন দুর্যোগ প্রশমনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নিঃসন্দেহে বলা যায়। ঠিক এমন সময় জাতীয় সংসদে ২টি শূন্য আসনে উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার বুকে গণপরিবহণে দিনে দুপুরে যে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, আবার বিএনপি-জামায়াত চক্র ঘটালো বলে মনে হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই অশনি সংকেত। যে দল আজ পর্যন্ত একটা বড় মহাসমাবেশ করে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে ব্যর্থ; নির্বাচন এলেই হয় বয়কট আর না হয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে- এই কারণে তাদের জনসমর্থন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সেই দল পূর্বের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গিয়ে আবার রাজপথে ধ্বংসযজ্ঞ পরিকল্পনা নিয়ে থাকে; তা শুধু দেশের জনগণের জন্যই নয় বরং বিরোধী দলের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশ, সরকার ও জনগণ একটা মহাদুর্যোগকাল অতিক্রম করছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা গোটা ইউরোপ মহাদেশকে নাজেহাল করে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনার সংক্রমণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সীমিত করতে হচ্ছে। রাতে কারফিউ ও লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে। প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু না হলেও সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে জাতিকে সতর্ক করে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার নির্দেশ কতটা পালন করা হচ্ছে- সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েই গেছে। প্রথমবার করোনার সংক্রমণকালে প্রধানমন্ত্রী যথা সময়ে জাতিকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু যাদের মহামারি দুর্যোগ প্রতিরোধ করার কথা ছিল; তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করেছেন বলে মনে হয় না। ফলে বেশকিছু অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। যে ৩টি প্রধান শর্ত জনগণের মেনে চলা উচিত যথা- বাধ্যতামূলকভাবে সবার মাক্স পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সভা সমাবেশের আয়োজন করা। এর কোনোটাই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হচ্ছে বলে মনে হয় না। দেশ যখন এমন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, তখন সহিংসতার মাধ্যমে সরকার পতনের লক্ষ্যে আবার রাজপথে অগ্নি সংযোগ, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন; এই ধরনের কর্মসূচি কীভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট এই সংকটকালীন নিলেন তা সত্যিই দুঃখ জনক। করোনা মহামারির কারণে দেশের রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থবির হয়ে আছে। একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সক্রিয় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে মন্ত্রিসভার বৈঠক ও সরকারি প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে প্রশাসন যন্ত্র সচল রেখেছেন ও মাঠ প্রশাসনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করছেন। একটা গণতান্ত্রিক দেশ যেভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা, তা তো করোনার কারণে প্রায় ১ বছর হতে যাচ্ছে, স্থবির হয়ে আছে। ছোট খাটো বিষয় ছাড়া জনগণের বৃহৎ অংশগ্রহণে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আর বিরোধী দল বিএনপি তাদের গৃহদ্বন্দ্বে এমনভাবে জর্জরিত যে, তাদের পক্ষে সাধারণ রাজনীতি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ ও ক্রিমিনাল মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় নেতৃত্ব খালেদাপুত্র তারেক রহমান খুনের মামলায় দন্ডিত আসামি। অদূর ভবিষ্যতে দেশে ফিরবার তার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিদেশ থেকেই যত ষড়যন্ত্র, কুপরামর্শ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাবার মতো দায়িত্ব পালন করে চলেছে। আন্দোলন করার মতো দিকনির্দেশনা কাদের মাধ্যমে বিএনপি পেল এবং কি কারণে তা হঠাৎ করে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় গণপরিবহণে সহিংস অগ্নি সংযোগ চালাল, তা জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। সরকার থেকে যতটুকু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে, তা সংগঠিত ঘটনার সঙ্গে যথার্থ কিনা সন্দেহ আছে। সরকার হয়তো ভেবেছেন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ধরনের বিচ্ছিন্ন সহিংস ঘটনা কোনো অবস্থাতেই মারাত্মক আকার সৃষ্টি করবে না। তা ছাড়া প্রশাসন, দলীয় কর্মী, নিরাপত্তা বাহিনী ও সাধারণ জনগণ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে, তাতে হয়তো তাদের উদ্বেগের কারণ নেই। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার এই সেদিন জেদ্দা ও দুবাইতে যেসব ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক কথোপকথনের কথা জানা গেল এবং জামায়াত-বিএনপির নেতারা যারা ওই বৈঠকের সঙ্গে জড়িত; বিশেষ করে আইএসের সঙ্গে সংযোগের সবকিছু বিবেচনার বাইরে রেখে শুধু বাসে অগ্নি সংযোগের ঘটনাকে তুচ্ছ ঘটনা মনে করা উচিত হবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, অতীতের মতো ষড়যন্ত্র চলছে। তাই সবাইকে সাবধান হতে হবে। বাসে অগ্নি সংযোগের ফলে কোনো প্রাণহানি হয়নি ঠিক, তবে বড় নাসকতার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোন সুদূরপ্রসারী নাসকতার ষড়যন্ত্র হয়েছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার। বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়া সঠিক হবে না। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২ বছর পূর্ণ হচ্ছে। করোনার কারণে সর্বক্ষেত্রে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে সরকার যেসব মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন ও চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশিল ও শান্তিপূর্ণ থাকা দরকার। বিরোধী দল বিএনপি জোট যাতে অহেতুক ধ্বংসযজ্ঞ কর্মসূচি দ্বারা সরকারের কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে না পারে, সেই জন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সরকারের মারমুখী হওয়ার দরকার নেই। তবে নিরন্তর সতর্কতা ও যথা সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রশ্নে কোনো শিথিলতা কাম্য নয়। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়; হত্যা, কু্য ও ষড়যন্ত্র যাদের রাজনীতির অবলম্বন, বারবার তারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাবে এটাই স্বাভাবিক। আইনের শাসনের ধারায় এদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় পদক্ষেপ বাঞ্ছনীয়।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে