বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষির পাশাপাশি শিল্প খাতের উন্নয়ন অনস্বীকার্য

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পলস্নী এলাকার এসএমই উদ্যোক্তারা সহজেই তাদের পণ্য শহরের মার্কেটে নিয়ে আসতে পারেন এবং ভালো মূল্য পেয়ে থাকেন।
হাছিবুল বাসার মানিক
  ১৭ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রাণ কৃষি হলেও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষির পাশাপাশি শিল্প খাতের উন্নয়ন অনস্বীকার্য। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশ শিল্পোন্নয়নের অভিযাত্রায় অনেকদূর এগিয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের বিকাশ শিল্পোন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

সরকার দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে এসএমইকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মতে- 'যে শিল্প-কারখানা একই পরিবারের সদস্য দ্বারা পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত এবং পারিবারিক কারিগর খন্ডকালীন বা পূর্ণ সময়ের জন্য উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থাকেন এবং যে শিল্পে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হলে ১০ জনের বেশি এবং শক্তিচালিত যন্ত্র ব্যবহৃত না হলে ২০ জনের বেশি কারিগর উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থাকে না তাই কুটিরশিল্প'।

যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি শিল্প খাত। আর শিল্প খাত প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ওঠে এক বা একাধিক ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে। ক্ষুদ্র থেকেই বৃহৎ সৃষ্টি হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে রূপ নেয় বৃহৎ শিল্পের। ফলে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে টেকসই শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান বেশি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তথা এসএমইর কোনো বিকল্প নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর জাপানের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে সে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের অবদান অপরিসীম। এসএমই প্রতিষ্ঠান সে দেশের ৭০ শতাংশ চাকরির যোগানদাতা এবং উৎপাদিত পণ্যের ৫৬ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয় এসএমই প্রতিষ্ঠান থেকে।

উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌল কাঠামো বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অন্যতম মৌলিক নিয়ামক হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়ন।

এই মুহূর্তে এসএমই খাত দেশের সার্বিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, উৎপাদন বৃদ্ধি, আমদানিনির্ভরতা হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে এসএমই খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ বেশি। বিদু্যৎ ও জ্বালানি শক্তির ব্যবহারও অপেক্ষাকৃত কম এবং পরিবেশ দূষণও কম মাত্রায় হয়।

বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের বিকাশই হচ্ছে সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এসএমইর ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নকে বেছে নিয়েছে।

সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) অর্জনে সিএমএসএমই খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিকল্প নেই। জাতিসংঘে অনুমোদিত এসডিজি এবং গেস্নাবাল রোডম্যাপ-২০৩০-এ নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বেকারত্বের কারণে উচ্চশিক্ষিত তরওণদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। দেশে উচ্চশিক্ষিতের হার বাড়ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। দেশের অর্থনীতিতে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ সুযোগ সৃষ্টি এসএমই খাতে সম্ভব। কর্মসংস্থানের গতি বাড়াতে বিশ্বব্যাংক থেকে সরকার ৭৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিচ্ছে। এ অর্থ যদি এসএমই খাতে যথাযথভাবে বিনিয়োগ করা যায়, তা হলে দেশে বিরাট কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থনীতির মূল স্রোতে নারীদের অংশগ্রহণ একান্তভাবেই অপরিহার্য। দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সঙ্গেও বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতে নারীদের অংশগ্রহণের মাত্রা এখনো অপ্রতুল এবং নারী উদ্যোক্তাদের হার পুরুষদের তুলনায় এখনো অনেক কম।

অর্থনীতির মূলস্রোতে নারীদের অংশগ্রহণে বেশকিছু বাধা বিরাজমান রয়েছে। আমাদের নারীসমাজের নিষ্ঠা, মনোনিবেশ, উদ্ভাবন শক্তি ও শ্রম নিপুণতা আমাদের বিস্মিত করে। বিশেষ করে মাইক্রো ক্রেডিট কার্যক্রম ও পোশাকশিল্পে নারীদের অব্যাহত অংশগ্রহণ শিল্পায়নে অত্যাধিক ভূমিকা রাখছে।

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। রূপকল্প ২০২১-এর আওতায় বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে (সিএম এসএমই) খাত দেশে শিল্পায়নের বিকল্প ও সম্প্রসারণে ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যদিয়ে নারীর আর্থিক নিরাপত্তা সুদৃঢ় হবে, পরিবার ও সমাজে লৈব্ধিক বৈষম্য দূর হবে, নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঋণপ্রাপ্তি ও সুদ বৈষম্যের কারণে বিকাশ থমকে আছে এসএমই খাতের। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত প্রত্যাশিত হারে বিকশিত হতে পারছে না। পর্যাপ্ত জামানতের অভাবে ঋণও নিতে পারছেন না এ খাতের উদ্যোক্তারা।

তা ছাড়া ব্যাংকগুলোও এ শিল্প খাতে ঋণ দিতে চাইছে না। এ সব সমস্যা-সমাধানে সরকারের উচিত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যত দ্রম্নত সম্ভব জবাবদিহিতার আওতায় আনা। একই সঙ্গে এসএমই সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন, রাজস্ব ব্যবস্থা শিথিলকরণ ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করা দরকার। বড় গ্রাহকদের সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ প্রদানের চেয়ে এসএমই উদ্যোক্তাদের সিঙ্গেল ডিজেটে ঋণ প্রদান করলে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।

দেশের কৃষি এবং সমগ্র শিল্প খাতের পাশাপাশি সংকটে থাকা ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাতকে সহায়তার লক্ষ্যে ঘোষিত হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা।

প্রণোদনা পৌঁছাতে করণীয় : এক. ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দ্রততার সঙ্গে প্রদানের ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব সহজ পদ্ধতি অবলম্বনে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন নীতিমালা করা যেতে পারে।

উক্ত নীতিমালা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ও সত্যিকার উদ্যোক্তাদের দ্রম্নততার সঙ্গে যথাসময়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা দরকার। দুই. বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর, বিসিক, তাঁত বোর্ড, রেশম বোর্ড, এসএমই ফাউন্ডেশন, নাসিব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের সমন্বয়ে নির্ধারিত কার্যপরিধিসহ প্রণোদনা বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

তিন. চাহিদার আলোকে দেশের প্রত্যেক জেলাভিত্তিক ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং বরাদ্দকৃত টাকার পরিমাণ উলেস্নখপূর্বক তা স্থানীয় জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের জানিয়ে দেওয়া যায়। চার. ক্ষতিগ্রস্ত ও সত্যিকার উদ্যোক্তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশের এসএমই সেক্টরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যায় পিছিয়ে থাকার মূল কারণের অন্যতম হচ্ছে শিক্ষিত প্রযুক্তিবিদদের উদ্যোক্তা হতে অনাগ্রহ, কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, লাগসই প্রযুক্তির অভাব ইত্যাদি অনেক কিছু।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পলস্নী এলাকার এসএমই উদ্যোক্তারা সহজেই তাদের পণ্য শহরের মার্কেটে নিয়ে আসতে পারেন এবং ভালো মূল্য পেয়ে থাকেন।

এ জন্যই এসএমই সেক্টরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য যথাযথ পণ্য বিপণনের উপযুক্ত মার্কেট খোঁজার জন্য বা উৎপাদিত পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও প্রণোদনা প্রদান করা আবশ্যক। নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পণ্য বিপণনকে আকর্ষণীয় এবং সহজলভ্য করে তুলতে পারলে এসএমই খাত উপকৃত হবে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি এন্টারপ্রাইজগুলোর উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ খাতটি শ্রমঘন এবং উৎপাদন সময়কাল স্বল্প হওয়ায় জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্রম্নত অবদান রাখতে সক্ষম। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনে (বিশেষ করে চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল করা এবং নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে) এ খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই, উদ্যোগী ও উদ্যমী বাংলাদেশের যাত্রায় উদ্ভাবনী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ অর্থনীতি বিনির্মাণে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্পের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে।

হাছিবুল বাসার মানিক : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে