বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নদী খননের সঙ্গে দূষণমুক্ত করাও অত্যন্ত জরুরি

পানিই জীবন, কথাটি মনে রেখে সর্বদা পানির প্রবাহ সচল রাখতে নদীখননের সঙ্গে সঙ্গে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদীদূষণও ঠেকাতে হবে।
এম এ কাদের
  ১৬ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

যে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠেছিলেন- ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে। বলো কোথায় তোমার দেশ? তোমায় নেই কি চলার শেষ? দেশের সেই নদীগুলোর ওপর অন্যায়-অবিচারের দূষণচিত্র দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে গঙ্গার কাছে জানতে চান, তবুও তুমি বইছ কেন? (ভূপেন হাজারিকা)

বর্তমান সরকার দেশের নদ-নদীগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মাস্টার পস্ন্যানের আওতায় ১৭৮টি নদী খনন ও পূনরুদ্ধার করে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী করার কাজ শুরু করেছে। এ প্রকল্প ২০২০-২১ সালে শুরু হয়ে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

প্রথমাবস্থায় ঢাকার চার পাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী খনন ও দূষণমুক্ত করা হবে। তা ছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ হয়ে বরিশাল পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার খননকাজ আগামী বছরে শুরু হবে। এ সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ঝিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদী খনন ও বন্যা ব্যবস্থপনায় ৪ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া ভারত, বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে দুই দেশের নৌ প্রটোকলভুক্ত ৪৭০ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছে। এর আওতায় কালনি ও কুশিয়ারা নদীর আশুগঞ্জ, জাকিগঞ্জ নৌপথের ২৮৫ কিলোমিটার এবং যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ-দৈখাওয়ার ১৮৫ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হয়েছে।

বরিশাল বিভাগে ৩১টি নদী খনন, রক্ষণা-বেক্ষণে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। খুলনা বিভাগে ১২টি নদী ৬৫০ কিলোমিটার খনন ও বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ৭ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে। নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা নদী খননের পাশাপাশি নদী খেকো ও দখলদাররা যাতে আবার নতুন করে দখল করতে না পারে সে লক্ষ্যে তদারকি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও সারা দেশে নদী দূষণমুক্ত রাখার জন্য আজ পর্যন্ত তেমন কোনো ভূমিকা নেওয়া হয়নি। নদী দূষণমুক্ত রাখা না গেলে হাজার, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদী সচল রাখার সব উদ্যোগ ব্যাহত হতে পারে।

দেশে নদ-নদী দখল ও দূষণের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন ধরে এদিকে খেয়াল না দেওয়ায় দেশের ২৩০টি নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। এ সব নদ-নদী, প্রায় ১০ হাজার প্রভাবশালী ভূমিদসু্য দখলবাজরা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আসছে। তা ছাড়া নদীগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মিল-কলকারখানার বর্জ্য, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শহর, নগরের মানুষের ব্যবহারের দূষিত নোংরা পানি, শহর বাজারের (মাছ, মাংস বাজারের নোংরা বর্জ্য) ড্রেনে দীর্ঘদিন জমে থাকা দূষিত বর্জ্য সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযোগ রাখার কারণে সাংঘাতিকভাবে নদীদূষণ হচ্ছে। মৃত প্রায় এ সব নদ-নদীগুলো দেখলে মনে হয় এ যেন বর্জ্য রাখার ভাগাড়। এ সব নদ-নদী ধ্বংস করার পেছনে কাজ করছে এক ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সম্প্রতি সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ৪ ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে (সূত্র : সংবাদ ১৩-০৩-২০২০)। এতে বলা হয়েছে, নদ-নদী দখলবাজদের সঙ্গে অধিকাংশ স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডবিস্নউটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজস রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। সারা দেশে নদীদখল ও দূষণের চিত্রটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

নদীদূষণ ও দখল এখন নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রায় প্রতিদিনই নদীদূষণের ও দখলের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে চোখে পড়ে। বিআইডবিস্নউটিএ সব বিষয়ে দেখভাল করার কথা থাকলেও তারা তা না করে অনেক ক্ষেত্রে দখলদারদের সহযোগিতা করে আসছে। সারা দেশে নদী-নালা, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া দেশের অধিকাংশ মিল-কলকারখানার বর্জ্য ও বসতবাড়ি, হাট-বাজারের নোংরা দূষিত পানি, মৃত প্রাণী, প্রাণীর পচা উচ্ছিষ্ট অংশ অহরহ নদ-নদীতে ফেলা হচ্ছে। শহর এলাকায় বস্তিবাসীদের অপরিকল্পিত অস্বাস্থ্যকর টয়লেটব্যবস্থা ও বিভিন্ন ভবনের টয়লেট ড্রেনের সঙ্গে সংযোগ করে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদ-নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী ও জলজপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। নদীদূষণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, বড় বড় শহরের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে খাল নদীর সঙ্গে সংযোগ রাখায়। ঢাকা শহরের পরিবেশদূষণ অস্বাস্থ্যকর বুড়িগঙ্গার দূর্গন্ধযুক্ত পানি ও বিভিন্ন খাল ডোবার দিকে তাকালেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এভাবে নদীদূষণ ও দখলের কারণে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। তা ছাড়া নদীর প্রবাহ না থাকায় প্রতি বছরই বর্ষাকালে মারাত্মক বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীদূষণকারী শুধু প্রভাবশালী কল-কারখানার মালিকরাই নয়- সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে নদ-নদী দূষণ করছে। দেশের নদীগুলোর পাড়ে গড়ে ওঠা সিটি শহর ও শত শত পৌর এলাকায় বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশে সুগারমিলগুলো অস্বাস্থ্যকর- বর্জ্য, রোগ-জীবাণু বহনকারী মশা-মাছির উপদ্রব ও বংশবিস্তারের সাহায্য করে। এ বর্জ্যগুলো ড্রেনগুলোর মাধ্যমে সরাসরি নদীতে সংযোগ করা হয়, যা নদীদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।

দেশের বেশির ভাগ মিল-কলকারখানার বর্জ্য, নিজস্ব শোধনাগার না থাকায় দূষণকারীরা নদীগুলোকে তাদের নিজস্ব সম্পদ মনে করে নদীদূষণ করে পরিবেশ নষ্ট করছে। নদী দখল ও দূষণকারীরা এতই শক্তিশালী যে রাষ্ট্রীয় সব উদ্যোগ তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া নদীদখল এবং দূষণ ঠেকানোর জন্য সরকারি যে সব সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, দৃশ্যমান এ সব অনিয়ম দেখেও তাদের চুপ থাকার রহস্য উন্মেচিত হওয়া দরকার। অনেক সময় আমরা দেখেছি, সরকারের পক্ষ থেকে নদ-নদীমুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে প্রভাবশালীদের বাধার সম্মুখীন হয়ে আর বেশিদূর এগোতে পারে না, থেমে যায়। ক্ষমতাশীল, প্রভাবশালীদের স্বার্থের কাছে নদী উদ্ধারের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হোক দেশের ১৭ কোটি মানুষ তা আশা করে না।

\হনদী রক্ষায় শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। নদীর তীরে মিল-কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এর আগে যে সব মিল-কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার নেই সেগুলোর শোধনাগার তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশের বড় বড় শহর, সিটি শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকা দূষিত বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত না করে শোধনাগারের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজ ভাঙাশিল্প নদীদূষণ ও পরিবেশদূষণের কারণে বন্ধ করতে হবে, অথবা নদীদূষণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। লঞ্চ-স্টিমার নির্মাণ ও মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পাড়ে তৈলাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।

পানিই জীবন, কথাটি মনে রেখে সর্বদা পানির প্রবাহ সচল রাখতে নদীখননের সঙ্গে সঙ্গে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদীদূষণও ঠেকাতে হবে।

যেহেতু ক্ষমতাবান প্রভাবশালীরা নদীকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, নদীগুলো উদ্ধারের কাজে সরকারের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে কাজকে বেগমান করতে পারলে, খননের সঙ্গে সঙ্গে নদীদূষণমুক্ত হলে দেশের ২৩০টি নদী বাঁচবে, জলজপ্রাণী বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে, দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচবে।

এম এ কাদের : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে