শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্প বিপস্নবের মূলে ছিল আধুনিক উদ্ভাবন

মো. ওসমান গনি শুভ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

১৭ শতকের আগে মানুষের জীবিকা ছিল কৃষিনির্ভর। তখন মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের পরিচয় ছিল না বললেই চলে। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজ বাড়িতেই তৈরি করত। ব্যবসায়ীরা কারিগরের বাড়িতে কাঁচামাল পৌঁছে দিয়ে পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখত। তাই পণ্যের উৎপাদন খরচ ছিল ব্যাপক যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। এটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা। পৃথিবীতে মানবজাতীর জন্ম থেকেই তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে আর সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে বারবার ছিনিয়ে এনেছে মানবজাতীর বিজয়। আজ পর্যন্তও ধরে রেখেছে অপরাজেয় বিশেষণ। তাই এবারও মানুষ আবিষ্কার করল সমস্যার নতুন সমাধান। পণ্যের উৎপাদন খরচ তথা পরিবহণ খরচ কমানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন চিন্তা করতে থাকল। এ সব চিন্তা থেকে বেশকিছু উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছিল যা পৃথিবীতে শিল্পের এক বিপস্নব সাধিত হয়। যা শিল্প বিপস্নব নামে পরিচিত। ১৫ শতকের শেষের দিক থেকেই ব্রিটিশরা সারা বিশ্বে কলোনি গড়তে থাকে। পৃথিবীতে সমানুপাতিক হারে ছড়াতে থাকে তাদের আধিপত্য এবং বাণিজ্য। তাই তাদের পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল ছিল সহজলভ্য এবং পণ্য বাজারজাত করার জন্য ছিল এক বিশাল পৃথিবী। কিন্তু পণ্য উৎপাদন খচর ছিল অত্যধিক যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। ব্রিটিশরা শুধু অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল তাই নয়- তারা চিন্তা-চেতনায়ও ছিল সমৃদ্ধ। তারা বেশকিছু নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিল যা পণ্যকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনেছিল। এর ফলে বাড়তে থাকে পণ্যের চাহিদা। মানুষের চাহিদার জোগান দিতেই সমগ্র ব্রিটেনজুড়ে গড়ে উঠতে থাকে শত শত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যা পৃথিবীকে শিল্পায়িত করতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। তাই ব্রিটেনকে শিল্প বিপস্নবের জন্মস্থান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর এটা ছিল ১৭ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে। ১৭ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত বেশকিছু যন্ত্র উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছিল। এ সব যন্ত্র শিল্পোৎপাদন, যোগাযোগ, ব্যাংকিং ও পরিবহণ খাতে অকল্পনীয় পরিবর্তন করেছিল। এর মাধ্যমেই শিল্প বিপস্নবের সূচনা হয়েছিল। বিশেষভাবে বলতে গেলে শিল্প বিপস্নবের প্রধান নায়ক হলো বস্ত্রশিল্প। যখন বস্ত্রশিল্পে যন্ত্রের সমন্বয় হলো তখন এর উৎপাদন হার রাতারাতি বৃদ্ধি পেল যার ফলে উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমে গেল। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে ইংরেজ উদ্ভাবক জেমস হারগ্রেবসের ১৭৬৪ সালে তৈরি করা স্পিনিং জেনি (জেনি শব্দটির আভিধানিক অর্থ ইঞ্জিন)। এ যন্ত্র সুতা উৎপাদনের হার বৃদ্ধিসহ মানুষের পরিশ্রমকে কমিয়ে এনেছিল। ব্যবসায়ীরা এ যন্ত্র একটি ঘরে স্থাপন করত এবং কর্মীরা সেখানে এসে কাজ করত। তখন তারা ভাবতে শুরু করল কাজ মানুষের বাড়িতে নয়- মানুষ যাবে কাজের কাছে। এভাবেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু হলো। স্পিনিং জেনির উদ্ভাবক জেমস হারগ্রেবস মারা যাওয়ার সময় পুরো ব্রিটেনে প্রায় ২০,০০০ স্পিনিং জেনির ব্যবহার হচ্ছিল।

এরপর আরেক ইংরেজ উদ্ভাবক এডমুন্ড কাটওয়েট ১৭৮০ সালে উদ্ভাবন করেন 'পাওয়ার লুম' বা কাপড় বুনন যন্ত্র। এ পাওয়ার লুম বস্ত্রশিল্পকে আধুনিক বস্ত্রশিল্পে রূপান্তর করেছিল। শিল্প বিপস্নবের দ্বিতীয় নায়কের ভূমিকা পালন করে লৌহশিল্প। লোহা উৎপাদনের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে বাড়তে থাকে লোহা উৎপাদন এবং বড় বড় যন্ত্র যা বিভিন্ন শিল্পের উৎপাদন কাজ থেকে শুরু করে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করেছিল। ১৮ শতকের শুরুতে এ লৌহশিল্পে আসে এক বিশাল পরিবর্তন। আকরিক থেকে লোহা উৎপাদনের পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ আবিষ্কারক আব্রাহাম ডার্বি। এর পর আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি বেসিমার ১৮৫০ সালে আবিষ্কার করেন বেসিমার পদ্ধতি। ফলে লোহা উৎপাদন সহজ হয় এবং এ সব লোহা ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্পের যন্ত্র তৈরিতে যেমন- জাহাজ শিল্পে, গাড়ি তৈরিতে, বিল্ডিং তৈরিতে, মেশিন টুলস উৎপাদনসহ হাজারও শিল্পে। মানুষ পণ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করার ফলে পণ্য উৎপাদন হার বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হয়; কিন্তু উৎপাদন করা এ সব পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছতে অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল ব্যাপার ছিল। তখন পণ্য পরিবহণের একমাত্র বাহন ছিল জলতরী অথবা ঘোড়া বা অন্যান্য পশু দ্বারা চালিত গাড়ি। ১৭১২ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী থমাস নিউকমেন আবিষ্কার করেন বাষ্প ইঞ্জিন যা পরে স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ওয়াট ১৭৭০-এর দিকে এ যন্ত্রকে উন্নয়ন করে তৈরি করেন আধুনিক বাষ্প ইঞ্জিন। যা ব্যবহৃত হয় পাওয়ার উৎপাদনে, পাওয়ার লুম, রেলগাড়ি, জল জাহাজ ইত্যাদিতে। ফলে মানুষের যাতায়াত হয় সহজ এবং পণ্য আনা-নেওয়া কাজসহ কাঁচামাল স্থানান্তর সহজ হয়।

বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে এ ইঞ্জিনগুলো ব্যবহৃত হতে থাকে বিশাল বিশাল জল জাহাজগুলোতে। এ বিশাল বিশাল জাহাজগুলো পুরো আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে এফোঁড় ওফোঁড় করে ঘুরে বেড়াতে থাকে সারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে। ১৮০০ সালে রিচার্ড ট্রিভিথিক প্রথম বাষ্প ইঞ্জিনচালিত রেলগাড়ি ডিজাইন করেন। এর ফলে স্থলপথে যোগাযোগব্যবস্থা আরও সহজ হয়।

এভাবে ব্রিটেনের একঝাঁক মেধাবী মানুষের দ্বারা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয় বিশেষ কিছু যন্ত্র যা মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় শিল্পকে। যার ফলে শিল্পক্ষেত্রে সাধিত হয় বিপস্নব তথা রূপান্তরিত হয় আজকের শিল্পভিত্তিক বিশ্ব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে