শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা

এসএএইচ ওয়ালিউলস্নাহ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
  ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের দেশ কাঁপানো আন্দোলনের দুটি বছর পেরিয়ে গেলেও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলার লেশমাত্র। আন্দোলনের মুখে সরকার সব দাবি তখন মেনে নিলেও সে সব বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগই দৃষ্টিগোচর হয়নি দেশবাসীর। এখন পর্যন্ত উপেক্ষিত রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ২০১৮ সালে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ৫ দফা নির্দেশনা। প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ সারাদেশেই ঘটছে ভয়ঙ্কর সব সড়ক দুর্ঘটনা। সড়কে ঝরে পড়ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ, পঙ্গুত্ববরণ করছে আরও অগণিত মানুষ। করোনাকালেও থেমে নেই সড়ক দুর্ঘটনা; বরং বিগত কয়েকমাসের তুলনায় তা বেড়েছে কয়েকগুণ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত অক্টোবর মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩১৪টি। আর এ ৩১৪টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৩৮৩ জনের এবং আহত হয়েছেন আরও ৬৯৪ জন। যেখানে সেপ্টেম্বরে ২৭৩টি দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৩০৪। যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ এবং নিহতের ক্ষেত্রে বেড়ে ২৬ শতাংশ। আগস্ট মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৭৯ জন এবং জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সড়কে ঝরেছে ২ হাজার ৪৮২টি তাজা প্রাণ।

তবুও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। লকডাউনের কবলে পড়ে দীর্ঘ বেকারত্বের পর রাস্তায় ফিরেও পরিবহণ শ্রমিকদের আচার-অভ্যাসে নূ্যনতম পরিবর্তন আসেনি। ভাটা পড়েনি চালক-হেলপারদের স্বেচ্ছাচারী মনোবৃত্তিতে। গাড়ির মালিক-শ্রমিক থেকে শুরু করে যাত্রী কিংবা পথচারী কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। ফলস্বরূপ সড়কে বিশৃঙ্খলার ষোলোকলা যেন পূর্ণ হচ্ছে! মূলত সুশৃঙ্খল পরিবহণ ও সড়ক ব্যবস্থাপনার অভাব, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে টেকসই ও বিকল্প ব্যবস্থা না নেওয়া, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না ঘটানো, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গাফিলতি, নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা এবং যাত্রীদের সচেতনতার অভাবেই সড়কে ফেরানো যাচ্ছে না শৃঙ্খলা।

এ সব কারণ আমাদের সবারই কমবেশি জানা। তাহলে কারণ জানা থাকার পরেও সড়কে কেন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না? উল্টো প্রতি বছরে আনুপাতিক হারে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণ, পুলিশি মনিটরিং জোরদার, আইনের কঠোর প্রয়োগ, এ খাতের চাঁদা বাণিজ্য বন্ধ, বেসরকারি খাতের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারি আধুনিক গণপরিবহণ চালুর পরামর্শসহ চালক-যাত্রী-হেলপার-পথচারী সবাইকে সচেতন করার বিষয়গুলো বারবারই সামনে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কে কাকে সচেতন করবে? জনসাধারণকে সচেতন করার দায়িত্ব কার? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার দায়িত্বটা কে পালন করবে? সাধারণ নিয়মানুযায়ী সড়ক পরিচালনার দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের। আবার চালক কিংবা যাত্রী সড়কে যে-ই অনিয়ম করুক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। এখন পুলিশ এবং ট্রাফিক যদি অনিয়মকারীদের সঙ্গে জোট বেঁধে তাদের বিরুদ্ধে আইন বাস্তবায়ন না করে তাহলে দায়টা কার? সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজে পরিচ্ছন্ন থাকার এক ধরনের প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে এ সংশ্লিষ্ট প্রতিটা বিভাগে। দায় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। চালক, হেলপার, পথচারী, যাত্রী, পরিবহণ সংস্থা, মালিক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে সবার দায়িত্বটুকুন পালন করতে হবে। সঠিকভাবে যার যার দায়িত্ব পালনই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তথা দুর্ঘটনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এ সবের পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মোটরবাইকের নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। দ্বিচক্র এ যানটির উৎপাত সারা দেশেই এখন মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায়ও শীর্ষে রয়েছে যানটি। 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর (২০১৯ সালে) দেশব্যাপী ৪ হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২২৭। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৮টি দুর্ঘটনার জন্যই দায়ী মোটরবাইক এবং মোট নিহতের ১৯ শতাংশ ছিল মোটরবাইক দুর্ঘটনায়। রাইড শেয়ারিংয়ের নামে বিগত কয়েক বছরে যে বিপুলসংখ্যক মোটরবাইক বাংলাদেশের রাস্তায় নেমেছে তা ইতিমধ্যেই সংকট তৈরি করে ফেলেছে। দিনকে দিন (বিশেষত করোনাকালে) রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরবাইকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। অধিকসংখ্যক এ মোটরবাইক সড়কে নিরাপত্তা এবং সড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে। পৃথিবীর অনেক দেশ এরই মধ্যে এ সংকটে পড়ে গেছে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার ৬০ শতাংশই এখন মোটরবাইকের কারণে সংঘটিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রয়োজন সামগ্রিক সুব্যবস্থাপনার। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কর্তৃপক্ষেরই তেমন আগ্রহ বা সদিচ্ছা দৃশ্যমান নয়। এর বড় কারণ, বাংলাদেশের পরিবহণ খাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দুর্নীতি, রাজনীতি ও চাঁদাবাজির মতো বিষয়। এখান থেকে পরিবহণ সেক্টরের বাইরেও অনেক পক্ষ মুনাফা ভোগ করে। এ খাতে চলছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। এ সব নৈরাজ্য থামাতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে সরকারকেই আন্তরিক হয়ে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে বিদ্যমান আইন। সড়কে শৃঙ্খলা না- ফেরার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকমুক্ত সড়ক। নতুন আইনে ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালকের সাজা কয়েকগুণ বাড়ালেও তা প্রয়োগে সরকার, বিআরটিএ এবং পুলিশ সর্বোচ্চ নমনীয়তা দেখাচ্ছে। ফলস্বরূপ ৫ লক্ষাধিক ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন কয়েক লাখ চালক রাস্তায় বহাল তবিয়তে চলাচল করছে।

এক কথায়, সড়কের নৈরাজ্য থামিয়ে শৃঙ্খলা ফেরাতে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পুলিশের। পাশাপাশি গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন, ছাত্রসমাজ, যাত্রী, চালক, পথচারীসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা থামাতে দরকার আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে