বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোথায় ক্ষমতার দাম্ভিকতা!

কিছু কিছু শিক্ষা অন্যের ভুল থেকেও নিতে হয়। কতিপয় অসৎ পুলিশ ভাইয়েরা সতর্ক হয়ে যান। প্রদীপ, আকবরের ভুল থেকেও যদি অন্যান্য পুলিশের শিক্ষা না হয় তাহলে এদের পরিণতির কথা মনে রাখুন।
মোহাম্মদ আবু নোমান
  ১৪ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

ক্ষমতার বড়াই দেখিয়ে মাত্র এক মাস আগে যিনি রাজার মতো চলেছেন; সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, রায়হান হত্যা মামলার আসামি বরখাস্তকৃত এসআই আকবর আজ রাস্তায় ফকিরের মতো প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছেন। ক্ষমতার দাপট চিরদিন থাকে না। মাত্র দেড় দুই মাস আগে যে আকবরের ছিল সিংহের মতো তেজ! বাঘের মতো গর্জন! আর এখন মেছু বিড়াল! এটাই হলো নিয়তির খেলা বা শিক্ষা। কোমরে দড়ি লাগানো, দুই হাত পেছনে বাঁধা। তাকে ঘিরে আছে ৭ থেকে ৮ জন যুবক। হিন্দি ও খাসিয়া ভাষাতে কথা বলছেন সবাই। আকবরকে নানা রকম প্রশ্নও জিজ্ঞেস করছেন তারা। ভিডিওতে দেখা গেছে, পুরো এলাকা পাহাড়, বন ও ঝোপঝাড়ে বেষ্টিত। আকবরকে সন্ত্রস্ত অবস্থায় একাধিকবার 'মুঝে জান ভিক্ষা দে না ভাই' বলে আকুতি জানাতে শোনা গেছে। আকবরকে ঘিরে রাখা যুবকরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মাঝেমধ্যে তাকে আঘাত করছিলেন। ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে! আকবরের মুখে এ রকম আর্তনাদ শুনে একজনকে বলতে শোনা যায়, 'হাম লোক কিয়া ফয়সালা করেগা, ওদার ফয়সালা করে গা...।' তখন আকবর বলেন, 'গোপাল খাঁকে ফোন দে না।' গোপাল কে? জানতে চাওয়ায় আকবর বলেন, 'মেরা ভাই গোপাল খাঁ।' এ কথা বলে আকবর আবারও বলে ওঠেন, 'মুঝে জান ভিক্ষা দে ভাই।' তখন 'চুপ থাক' বলে তাকে শাসানো হয়। এখন এত মিনতি, অস্ত্র হাতে আকবররা কতটা হিংস্র হয়ে উঠে, তার প্রমাণ আকবর ও তার উত্তরসূরি ওসি প্রদীপের মাধ্যমে জাতি ইতোমধ্যেই দেখেছে।

ক্ষমতা বড়ই পিচ্ছিল

এসআই আকবরের নিজের জীবনের জন্য কত মায়া। অথচ আরেকটি জীবন কেড়ে নেয়ার সময় একবারও ভাবেননি। না জানি বিনা দোষে এরকম হাজারো অসহায়ের আর্তনাদ কান দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায়নি পুলিশ রূপি পশুটার। না জানি কত মায়ের, সন্তানের, প্রিয় স্ত্রীর, শান্তির সংসার, আরামের ঘুম চিরদিনের মতো হারাম করেছে এই পুলিশ রূপি হায়েনা আকবর। কিন্তু তখন ক্ষমতার দাপটে এসআই আকবরের কলিজা একটুও কাঁপেনি। আর এখন নিজের জীবন বাঁচাতে কতই না আকুতি। বাঁচার জন্য হিন্দি, খাসিয়া ভাষা বলে ন্যাকামি করেও শেষ রক্ষা হলো না। ধরা পড়ার সময় মুখে দাড়ি, 'কুমার দেব' বলে নাম পরিচয়, বেশভূষায় 'খাসিয়া' সেজে পুঁতির মালা গলায় দিয়েও পাপ মোচন করা যায়নি। অহংকার যে মানুষের পতনের মূল, তার বাস্তব উদাহরণ এসআই আকবর। ক্ষমতা বড়ই পিচ্ছিল জিনিস, আকবর এখন টের পাচ্ছেন। বাকি আকবর, প্রদীপরা এ থেকে শিক্ষা নেবেন কী?

আকবরের কান্না

রায়হানের লাশ দেখে বুঝা গেছে, তাকে কতটা অমানসিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। রায়হানও তার জীবন বাঁচাতে নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি আকুতি-মিনতি করেছিল। আকবর তা শুনেনি। এখন যেভাবে মায়াকান্না করছে এসআই আকবর, হয়তো রায়হানও এভাবে সেদিন মৃতু্যযন্ত্রণায় কান্না করেছিল। সর্বসাধারণ তা দেখেনি। কিন্তু আজ আকবর সবার কাছে প্রকাশ্যে জান ভিক্ষা চাইছে- যা সবাই দেখছে। এটাই সত্য, চিরদিন কারো সময় সমান যায় না। শুধু এসআই আকবর কিংবা ওসি প্রদীপ এমন করছে তা কিন্তু নয়, এদের মতো আরও হাজারো আছে, যাদের হাতে আজ ক্ষমতা, তাই যার সঙ্গে যাচ্ছেতাই করছে। কোথায় গেল আজ আকবরের সে ক্ষমতা! কোথায় দাম্ভিকতা! ক্ষমতা নিয়ে বড়াই করতে নেই, এটা তার প্রমাণ। এক সময়ের বন্দরবাজার এলাকার মহা প্রতাপশালী পুলিশ অফিসার আকবর আজকে অতি সাধারণ মানুষের কাছে হাত জোড় করে কান্নার সুরে কথা বলছে। অতি সাধারণ মানুষ তার কোমড়ে, হাতে, পায়ে, দড়ি বেঁধেছে। এটা প্রকৃতির বিচার। ক্ষমতা, দাম্ভিকতা, অহঙ্কার এবং সৌন্দর্য চিরস্থায়ী নয়। এসআই আকবর ও প্রদীপের মতো অসৎ পুলিশরা এ থেকে কিছু বুঝেছেন কী?

জান ভিক্ষায় পুলিশের গর্বিত সদস্য আকবর

রায়হানও হয়তো মৃতু্যর আগে এভাবেই বলেছিল আমার জান ভিক্ষা দাও। আজ এসআই আকবর সেই একই লাইনটা বলছেন। জান ভিক্ষা চাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের 'গর্বিত' সদস্য, নিজেকে বড় 'লাটসাব' মনে করা এসআই আকবর। অথচ সে যখন রায়হানকে মেরে ফেলে তখন কিন্তু এটা মনে ছিল না যে, রায়হানের স্ত্রী বিধবা হবে, কয়েক মাস বয়সের কন্যা সন্তানটি হবে এতিম, মা হারাবে তার কলিজার টুকরা, বোন হারাবে তার আদরের ভাইকে। এজন্যই মানুষ বলে, 'পাপ নিজের বাপকেও ছাড়ে না।'

অপরাধী পুলিশ

বাংলাদেশের অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গে পুলিশ জড়িত! কোন ক্ষেত্রে নিজেরাই অপরাধী, নয়তো অপরাধীদের সহযোগী! পুলিশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ ছাড়া কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় না, বা হতে পারে না। হাজারো পুলিশ অপরাধী, যারটা গোপন থাকে না সে অপরাধী হয়ে যায়, বাকিগুলো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। সাধারণ জনগণের যে কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বরাবরই অতি উৎসাহী, অতি লোভী, অতি আবেগী, অতি আগ্রহী হয়ে থাকেন। কত আরাম আয়েশের জীবন ছিল আকবরের। আজ সাধারণ চোরদের মতোই বসে আকবরের হাতজোড় করা, বসার ধরন ও বাঁধা অবস্থা, এগুলো আগামী আকবরদের জন্য সতর্কবার্তা। হয়তো নিষ্পাপ কারো দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। কত অসহায়, না জানি কত নির্দোষ মানুষ তার কাছে হাত জোড় করে বলেছিল, আমি অন্যায় করিনি, আর আজ সে হাত জোড় করছে মানুষের কাছে।

ভুল থেকে শিক্ষা

কিছু কিছু শিক্ষা অন্যের ভুল থেকেও নিতে হয়। কতিপয় অসৎ পুলিশ ভাইয়েরা সতর্ক হয়ে যান। প্রদীপ, আকবরের ভুল থেকেও যদি অন্যান্য পুলিশের শিক্ষা না হয় তাহলে এদের পরিণতির কথা মনে রাখুন।

সময়ের ব্যবধানে আজ এসআই আকবর কতটা অসহায় তা অনুধাবন করতে হবে। লোভে পাপ আর পাপে মৃতু্য, চিরন্তন সত্য। মানুষ ভুল করার আগে যদি ভাবতো যে, তার করা ভুলের মাসুল কতটুকু তাকে এবং তার পরিবারকে দিতে হবে, তাহলে সে কখনোই, ভুল করতে পারে না। অতি উৎসাহী কিংবা অতি আগ্রহী কোনোটাই হওয়া উচিত নয়।

জানা যায়, বন্দরবাজার এলাকার মহা প্রতাপশালী এসআই আকবর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চাঁদাবাজি চালিয়ে গেছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কোনো কিছু করার সাহস ছিল না। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ ছিল না। পুলিশ গ্রেপ্তার করার আগে সাধারণ জনগণ তার হাতে, পায়ে ও কোমড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে এসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের ভাবমূর্তি

আকবর ও প্রদীপ নামের পুলিশ অফিসারদের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। মানুষ এখন পুলিশকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। আমাদের পুলিশ বাহিনীর অসংখ্য অর্জন রয়েছে। ওসি প্রদীপ বা আকবরদের জন্য এসব অর্জন মস্নান হয়ে যাক তা কাম্য নয়। পুলিশের সৎ অফিসারদের বিনা বাধায় কাজ করতে দিলে ১ মাসে দেশের অপরাধ নির্মূল সম্ভব। যারা ক্ষমতা পেয়ে সরকারি চাকরি নামক 'সোনার চামচ' মুখে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তারা দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকদের দিকে তাকান, মাটির দিকে তাকান যার নিচে জেতে হবে, উপরের দিকে তাকান তিনি আপনার চেয়ে অনেক অনেক ক্ষমতাবান। সুতরাং, অন্যায়ভাবে সামান্য সার্থের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেবেন না। আলস্নাহকে ছাড়া কারো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। অতএব, অন্যায় করার আগে নিজের পরিবারের কথা ভাবুন, যাকে অন্যায়ভাবে বিপদে ফেলে দিলেন তার পরিবারের কথা ভাবুন। আপনি আজ ক্ষমতার বলে একজনকে বিপদে ফেললেন, মনে রাখবেন এই বিপদ খুব তাড়াতাড়ি আপনার ওপর, আপনার পরিবারের ওপর হাজারো গুণ বেশি হয়ে ঘুরে আসবে। যে পুলিশ ক্ষমতার দাপটে একটা নিরীহ তরতাজা যুবককে হায়েনার মতো পিটিয়ে হত্যা করল। সাধারণ মানুষ আজ ওই জানোয়ারটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গরুর মতো টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় আজ ক্ষমতা, কোথায় দম্ভ!

পুলিশের সেবার বেহাল অবস্থা

মাত্র ১০ হাজার টাকা না দেওয়ায় সিলেট পুলিশ ফাঁড়িতে গত ১০ অক্টোবর রাতভর নির্যাতন করে রায়হান নামের ছেলেটিকে হত্যা করা হয়। ওই রাতে টাকা আদায় হলে, সিনিয়র অফিসারও ভাগ পেতেন। ঘুষের ব্যাপারে পুলিশের চেইন অব কমান্ড খুব চমৎকার! নিহত রায়হানের ২ মাসের একটা সন্তান আছে এবং চলতি মাসেই তার আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তাকে প্রদীপের উত্তরসূরিরা বাঁচতে দিল না। খুবই দুঃখজনক এরকম একটি তরতাজা যুবককে পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমাদের দেশে মানব সেবার অতি সংবেদনশীল জায়গা হাসপাতাল ও পুলিশের সেবার বেহাল অবস্থার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এসআই আকবর ও প্রদীপ। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত, যাতে বাকিরা নিজেকে মহা ক্ষমতাবান মনে না করে নিজেকে একজন জনগণের সেবক মনে করে। মনে রাখতে হবে প্রত্যেকের কর্মই তার ভবিষ্যৎকে মূল্যায়ন করে থাকে। আকবরের ভিডিওর শিক্ষা হচ্ছে জুলুমবাজ যত শক্তিশালী হোক তার পতন হবেই। জুলুমবাজ যারা আছেন তারা আকবর, প্রদীপের মতো (পুলিশের পোশাক পরা সন্ত্রাসী) পরিনতি দেখে হুস না হলে অপেক্ষা করুন। ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণই আজ তাদের এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে। এ ঘটনা থেকে দায়িত্বশীলরা শিক্ষা নিলে এমন ঘটনা অনেকাংশেই কমে যাবে।

কে সেই সিনিয়র অফিসার?

একটি ভিডিওতে আকবরকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা দেখতে পাওয়া যায়। হাত পেছনে রেখে রশি বেঁধে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেও দেখা গেছে কয়েকজনকে। জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে আকবর বলেন, 'আমাকে একজন সিনিয়র অফিসার বলেছেন, তুমি চলে যাও, দুই মাস পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরে আসবা।' আকবরের কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে কে সেই সিনিয়র অফিসার? বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িটি কোতোয়ালি থানার অধীন। আকবরকে অভয় দেওয়া সেই অফিসারটি কি এ থানার কেউ? এ থানায় তার মাথার উপরে রয়েছেন তিনজন। এরা হলেন- ইন্সপেক্টর (তদন্ত), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সহকারী কমিশনার (এসি)। নাকি এরা কেউই নন, আরও উপরের কেউ? তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারবে সেই নাম। তারা কি জানাবে সেই অফিসারের নাম? আকবরের বয়ান অর্থাৎ সিনিয়র অফিসার তাকে ২ মাসের জন্য পালিয়ে থাকার উপদেশ বাণী এক ভয়ংকর সংঘবদ্ধ গ্রম্নপের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয় কী?

মোহাম্মদ আবু নোমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে