শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে তা অনুপস্থিত

বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয় না কেন? গরিব-দুঃখী মানুষের কি সামাজিক সম্পদের কোনো অধিকার নেই। তাদের মাথাগোঁজার মতো জায়গা থাকবে না কেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ধনীর আদরের সন্তানরা যখন নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আবদ্ধ, তখন গরিবের সন্তানরাই একাত্তরে অস্ত্র ধরে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
ডা. এস এ মালেক
  ১৪ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

আমরা স্বাধীন এ কথার অর্থ তাই নয়, যা আমরা আমাদের খেয়াল খুশিমতো করতে চাই; তা করতে পারি। আমরা স্বাধীন হলেও আমরা সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের নিয়ম কানুন, প্রথা মেনেই বসবাস করতে হয়। তেমনি রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন-কানুন, নীতি- নৈতিকতার কাছে আমরা পরাধীন। আমরা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের সংবিধানে বর্ণিত রয়েছে আমাদের করণীয় বিষয়। সংবিধানভিত্তিক আইন করে রাষ্ট্র তা সরকারের মাধ্যমে মেনে চলতে নির্দেশ দেয়। সবকিছু সংবিধানে লিখা থাকে না; এমনকি আইনের আওতায় হয়তো নেই। তাহলেও নৈতিকতার প্রয়োজনে অনেক বিধিবিধান আমাদের আইনের চেয়েও কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকদের জন্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সচেতন মানুষ নৈতিকতার মানদন্ড অনুসরণ করে। যারা তা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিচ্ছে; তারাই কিন্তু প্রকৃত অর্থে সমাজকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। যেসব নীতিমালা, নিয়ম-কানুন, পদ্ধতিগতভাবে এইটা সমাজে বহুদিন চলে আসছে, তা ভালোই হোক বা মন্দই হোক- সমাজের নির্ধারক হিসেবে তা মেনে চলা হয়। যে সমাজ পশ্চাৎপদতার কারণে অনিয়মকে নিয়ম, দুর্নীতিকে সুনীতি, মন্দকে ভালো ও অপসংস্কৃতিকে সংস্কৃতি বলে গণ্য হয়ে আসছে, সে সমাজ দোষে দুষ্ট এবং সংস্কারের জন্য অপেক্ষমাণ। যুগে যুগে সমাজ সংস্কারকদের আবির্ভাবে সমাজ ক্রমবিকাশের ধারায় এগিয়ে চলেছে। ধরুন আমাদের বাংলাদেশের কথা। আমরা পরাধীন ছিলাম প্রায় ২০০ বছর।

\হব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে এই দীর্ঘ সময়ে পিষ্ট হয়েছি। তারপর ২৪ বছর পাকিস্তানের শাসন-শোষণ ও বৈষম্যের শিকার। পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিল পরাধীন। বাঙালি স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। আমাদের মহান স্বাধীনতা আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়- অসাম্প্রদায়িক হতে, ধর্ম নিরপেক্ষ থাকতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ হতে। পারস্পরিক অধিকারকে মেনে নিয়ে শ্রেণি-বৈষ্যমের বিলোপ ঘটাতে। সমাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে। সমাজের প্রতিটি মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখতে, নারী-পুরুষের জন্য সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করতে। সর্ব প্রকার নির্যাতন থেকে প্রতিটি মানুষের অধিকার ও পাওনা এবং সর্ব প্রকার শোষণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে। আসুন একবার ভেবে দেখি স্বাধীনতার এই দিকনির্দেশনা আমরা কতটুকু মেনে চলছি।

\হআমাদের সংবিধান বলছে, ৪টি মূল দর্শনভিত্তিক জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র চর্চা হওয়া দরকার। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। সত্যিকার বিবেচনায় আমরা স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরও কি সেগুলো অর্জন করতে পেরেছি? সাম্প্রদায়িকতার উস্কানিতে একটা অঘটন ঘটিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি-বাস্তুভিটা অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়। এটাতো নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অহরহ এসব দুঃখজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। ধর্মীয় মমত্ববোধ ও সহিষ্ণুতা আমরা কি অনুসরণ করছি। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধানমন্ডির কলাবাগানে ধর্মীয়ভাবে সচেতন একটা সংখ্যালঘু পরিবার আমাদের পড়শি হিসেবে বসবাস করতেন একজন সাধু। একটা স্বাধীন বাংলাদেশেই ঘটেছে ওই সাধুর ওপর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল। ওই বাড়িতে সন্ধ্যার সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালিয়ে শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে সাধনারত থাকতেন ওই সাধু। ওটা ঘটতো প্রায় মাগরিবের নামাজের সময়। ওখান থেকে মসজিদের অবস্থান বেশকিছু দূরে ছিল। সেখান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের নামাজের প্রার্থনায় অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বেশকিছু সমাজের কর্তা ব্যক্তিরা আমার কাছে এসে অভিযোগ করলেন নামাজের সময় ওটা না বাজালে চলে না। বললাম মসজিদ তো অনেক দূরে। নামাজের তো কোনরূপ বিঘ্ন হওয়ার কথা নয়। অথচ এই বাংলাদেশে এখনো এমন জায়গা আছে, যেখানে মসজিদ-মন্দির একই আঙিনায়। ঢোলের বাজনা ও শঙ্খধ্বনি যারা হিন্দুয়ানা সংস্কৃতি বলে মনে করেন; তারা কি উদার সম্পন্ন ধর্মীয় কোনো ব্যক্তি না সাম্প্রদায়িক চেতনার পথভ্রস্ট তাদের ধর্মীয় দর্শন। এটা একটা শিক্ষিত সমাজের কথা বললাম। যারা অভিযোগ তুলেছিলেন তারা সমাজের জ্ঞানী-গুণি ও উচ্চ পর্যায়ের লোক। ১৯৪৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেখা যাবে যেসব বড় বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে, তা খুব তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে। উস্কানিমূলক আচরণের কারণে তা মহিরুহ রূপ ধারণ করেছে। আমি একথা বলছি না বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার কারণে এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা সক্রিয়। দেড় কোটি নয়, এখানে যদি ১০০ জন সংখ্যালঘু বসবাস করতেন ও তাদের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার বীজ লুকায়িত থাকতো, তাহলে তারাও কিন্তু সাম্প্রদায়িক সংকট সৃষ্টি করতে পারতেন। আমরা মুখে প্রায়ই গণতন্ত্রের কথা বলি। শিক্ষিত সমাজ তো প্রায়ই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু তারা গণতন্ত্রের কতটুকু চর্চা করেন। সমাজে চলাফেরা, ওঠা বসা, আচার-আচরণে, চাল-চলনে আমরা একজন, অপরের অধিকার সম্পর্কে কতটা সচেতন আছি। আমরা অনুসরণ করি বা না করি সমাজ ব্যবস্থা কিন্তু গণতান্ত্রিক।

এ সমাজে প্রতিটি মানুষের পরিবারের অধিকার রয়েছে সম্পদ ভোগের। প্রকৃতির সবাই স্থাবর, অস্থাবর সম্পদের অধিকারী হওয়ার। কিন্তু এই অধিকারের প্রশ্নে যখন দ্বন্দ্ব হয়, তখন আমরা এতটাই উন্মাদ হয়ে পড়ি যে, অন্যর জীবন কেড়ে নিতেও দ্বিধাবোধ করি না। সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, পুত্র, ভাই বোনকে হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। অথচ আইনে নির্ধারিত আছে, কে কতটুকু সম্পদের অধিকারী হবেন। আমি পারিবারিক সম্পদের কথা বলছি। একজন সম্পদশালী মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার উত্তরসূরিদের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব লাগে। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। আইনের বাধ্যবধাকতা আছে। কিন্তু কতজন তা মেনে চলছি। আত্মস্বার্থে আঘাত লাগলে আমরা ন্যায়নীতির কথা ভুলে যায়। আরও, খাব আরও চাই। এ কারণে নিজের ভাইকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করি না। যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদের কথা বলি তাহলে সীমাহীন সম্পদ যারা নিজেদের আওতায় নিতে সক্ষম হয়েছে, যেমন সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ, উচ্চ ক্ষমতাধর শোষক শ্রেণি; তারা কি একবার ভেবে দেখেছেন কি মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও সম্পদ আহরণ ও ভোগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইন বা সামাজিক বিধান মেনে চলেন। যান আইন আদলতে। লাখ লাখ মামলা ঝুলছে। ৫ কাঠা জমি অথবা একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা নিয়ে বছরের বছর মামলা চলছে। যার সমাধান সুস্থ একটা গণতান্ত্রিক সমাজ সহজেই করে দিতে পারে। যদি ন্যায় বিচারের কথা বলা হয়, তবে যারা ৯০ ভাগ সম্পদ কবজায় নিয়েছেন, তিনিও আরও চান। আর যারা ১০ ভাগ সম্পদের মালিক, তারা শুধু ঠকেই চলেছেন। আর আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি। সামাজিক সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র আমাদের কি শিক্ষা দেয়? সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা কেন এত দৃঢ় কষ্ঠে বলা হয়।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয় না কেন? গরিব-দুঃখী মানুষের কি সামাজিক সম্পদের কোনো অধিকার নেই। তাদের মাথাগোঁজার মতো জায়গা থাকবে না কেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ধনীর আদরের সন্তানরা যখন নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আবদ্ধ, তখন গরিবের সন্তানরাই একাত্তরে অস্ত্র ধরে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।

\হমহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যদি মাথাগোঁজর ঠাঁই না পায়, স্কুল-কলেজে যদি তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকে, দিন এনে দিন খাওয়া যদি না জোটে, তা হলে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে যাদের কোনো কিছুই নেই, রাস্তায় যারা দিনে দিনে বেড়ে উঠে, প্রাকৃতিক বির্পযয়ের পর যারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে, তারা যদি দাবি করে আমরা ভাত চাই, বস্ত্র চাই, শিক্ষা চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই; বিদ্যমান গণতন্ত্র এর কি জবাব দেবে।

ডা. এস এ মালেক: কলামিস্ট ও রাজনীতিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে