বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের তাৎপর্য ড. মিল্টন বিশ্বাস

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল দিবসে ঘৃণা জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের।
নতুনধারা
  ১২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

আজ ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল দিবস। এ সম্পর্কে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, '১৯৯৬ সালে যখন ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি তখন সমালোচনা করা হয়েছিল, অনেকেই বলেছিল আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি। বিএনপি সেদিন খুনিদের রক্ষা করতে হরতাল ডেকেছিল। বিচারপতির পরিবারের ওপর হামলা হয়েছিল। একজন সাধারণ মানুষের হত্যার বিচার যেভাবে হয়, জাতির পিতার হত্যার বিচারও সেভাবেই হয়েছে।' কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন হলেও কয়েকজন খুনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর ২০ খুনিকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর আবাসিক সহকারী মুহিতুল ইসলাম। এরপর মামলা চলে প্রায় ১৩ বছর বিচারিক আদালতে। আদালত ১৫ জনকে মৃতু্যদন্ড দিলেও হাইকোর্ট ১২ জনের মৃতু্যদন্ড বহাল রাখে। দীর্ঘ ২১ বছর বিচার বন্ধ থাকার মূল কারণ ছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। যা বাতিল হওয়ার ফলে খুনিদের বিচারকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে এবং এ জন্যই আজকের এই দিনটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বলতম দিন, গৌরবময় দিন।

আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান জুড়ে এক অদ্ভুত কেলেঙ্কারির ইতিহাস রচিত হয়। প্রণীত হয় ইনডেমনিটি বিল। ইনডেমনিটি হলো কোনো বিচারকার্যকে বাধা প্রদানসংক্রান্ত অধ্যাদেশ বা আইন। কোনো অভিযান বা অভু্যত্থানের ক্ষয়ক্ষতি আদালতের বহির্ভূত রাখার জন্য আইনসভা যে বিল পাস করে তাকেই  ইনডেমনিটি বিল বলে। এই শব্দের অর্থ শাস্তি এড়াইবার ব্যবস্থা অর্থাৎ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হলো সেই অধ্যাদেশ যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এই দায়মুক্তি আইন বাতিলের দিবসটি কেন আমরা স্মরণ করছি। কারণ এটি প্রণয়ন করেছিল খুনিদের প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা হলে হত্যাকান্ডে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে এ আইন করা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশে সংসদ অধিবেশন না থাকায় আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী হয়েও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোশতাক আহমেদ অধ্যাদেশ আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে এ আইন প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে খন্দকার মোশতাকই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে। আইনটি ১৯৭৫ সালের ৫০নং অধ্যাদেশ হিসেবে অভিহিত ছিল। ১৯৭৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনটি বাতিল করেন। যার ফলে বঙ্গন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ আবার খুলে যায়। ২০১০ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যেদিন সাক্ষরিত হয় সেদিন ছিল শুক্রবার। 'দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথোরিটি' লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক সাক্ষরিত। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পেশ করেন। এই ব্যক্তি রাজাকারদের মধ্যে অন্যতম ছিল। অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ আছে- প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উলিস্নখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। সংবিধানের গণতন্ত্র বিষয়টা খর্ব হবে বলে অনেকে বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতা বলে সংশোধনী বিল পাস করায়।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করায় এবং নিজে রাষ্ট্রপতি হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা পায়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল সংবিধান (সংশোধনী) আইন-১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিল- যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়।

পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেনি। এই সামরিক জান্তা বরং খুনিদের সুবিধা দিয়ে চাকরি দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃতু্যর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত করেনি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াত। এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করে আবার নিজের সুবিধার জন্য দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে- যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সব ধরনের সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি-নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২৩ ফেব্রম্নয়ারি, ২০০৩ 'যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল-২০০৩' নামে সবশেষে ইনডেমনিটি আইন পাস হয়।

বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ ইনডেমিনিটি ছিল এমন একটি আইন যা ইতিহাসে লজ্জাজনক। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, বন্দর নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হলেও সেসব দেশে ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি করা হয়েছিল। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশেই প্রথম ঘটেছিল এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃতু্যর ২০ বছর পার হলেও কোনো রাষ্ট্রপতি বা সরকারপ্রধান সেটি বাতিল না করে উল্টো নিজেদের সুবিধা নেওয়ার জন্য ইনডেমিনিটি বহাল রাখে। আওয়ামী লীগ সরকার  ক্ষমতায় আসার পরে আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য 'দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬' নামে একটি বিল উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর মাসে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারে শুরু হয়। উলেস্নখ্য, জিয়া সরকার খুনিদের বিচার না করে সরকারি উপর মহলে এবং বিদেশের দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করে। তারা পালিয়ে যায়; এখনো অনেকে পালিয়ে আছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার যারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির সমর্থক তারা ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। বিচারকরা বিব্রত হতে থাকেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিল-এর মাধ্যমে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে ১২ জনের মৃতু্যদন্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল দিবসে ঘৃণা জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের। ওই ঘাতকদের তালিকা হলো- লে. কর্নেল শরিফুল হক (ডালিম), লে. কর্নেল আজিজ পাশা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর শরিফুল হোসেন, কর্নেল কিসমত হাশেম, লে. খায়রুজ্জামান, লে. নাজমুল হোসেন, লে. আবদুল মাজেদ। বিচারের আগেই মৃতু্য ঘটে- খন্দকার মোশতাক আহমদ, মাহবুব আলম চাষী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা, রিসালদার সৈয়দ সারওয়ার হোসেন, লে. ক. মোহাম্মদ আজিজ পাশা (বিচার চলাকালে পলাতক অবস্থায় তার মৃতু্য হয়)। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলো- মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং এ কে এম মহিউদ্দিন। চলতি বছর (২০২০) কলকাতা থেকে ঢাকায় এলে ধরা পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছে ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ। অবশ্য মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ৬ জন আসামি এখনো পলাতক। এরা হলো- খোন্দকার আব্দুর রশিদ, নূর চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী এবং আবুল হাশেম মৃধা তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে; বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের দিনটি আরো বেশি সার্থকভাবে পালন করতে চাই আমরা।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ফৎসরষঃড়হনরংধিং১৯৭১@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে