শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ না হলে গরিবের বাঁচা দায়

দ্রব্যমূল্যর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে গরিবের বেঁচে থাকাই দায়। যেভাবে হোক সরকারকে বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে গরিবের মুখে হাসি ফোটাতে হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মো. শফিকুল ইসলাম
  ১০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

করোনাভাইরাস অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, ফলে মানুষের উপার্জন ক্ষমতা কমে যায়। গরিব এবং মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা খুবই সংকটময়। কারণ তাদের দৈনিক আয় কমছে। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক গরিব এবং মধ্যবিত্ত মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। কারণ রাজধানীতে কর্ম নেই। ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যায় কোনোভাবে বেঁচে থাকার জন্য। এভাবে হাজার হাজার মানুষ রাজধানী ছাড়ছে। খুবই দুর্দশায় চলছে তাদের জীবন। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার সময়। এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে এক কালো মেঘ হিসেবে হানা দিয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলো তাদের জীবনে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

দিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে চলছে। শুরুতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পায়, পরে চাল এবং এখন আলুর দাম বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সবজির দাম বেড়ে চলছে। কাঁচামরিচ কেজি প্রতি ২০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। মানুষ কি খাবে এবং কি করবে। বাজারে গেলে মানুষ এখন অসহায় হয়ে যায়। গরিব মানুষ খুবই মানবতার জীবনযাপন করছে। বর্তমানে আমরা খাদ্য উৎপাদনে ভালো সময় পার করছি। কারণ রূপালী ইলিশসহ, আলু, চাল উৎপাদনে ব্যাপক সফল আমাদের দেশের কৃষকরা। গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর জন্য বাংলাদেশকে আর ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং আলু, আম ও পেয়ারা উৎপাদনেও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। সবজি উৎপাদনেও আমরা অনেক দেশের চেয়ে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছি।

তবে আমাদের মারাত্মক সমস্যা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি। গত বছর এর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ বছরও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশে দাম বৃদ্ধি পাবে কেন? কারণ আমাদের দেশে যে পেঁয়াজ মজুত ছিল তাতে কিছু দিন বাজার সামাল দেওয়ার কথা। আর পেঁয়াজ আমদানিতে কেন শুধু ভারতের ওপর নির্ভরশীল? আমাদের অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা থাকলে বাজারে এই পরিস্থিতি নাও হতে পারত। এছাড়াও ভারত মনে করত তারা রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশ অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করবে। তখন ভারত এভাবে পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে নয়ছয় না করতে পারত।

২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৮০-৩০০ টাকা দামে কিনতে হয়। এই অবস্থা হয় ভারত থেকে সরবরাহ না হওয়া। এ বছর একই অবস্থা। তাই সরকারের উচিত ছিল বিকল্প উপায় বের করে পেঁয়াজ আমদানি করা। কিন্তু ভারত পূর্বঘোষণা ছাড়াই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করতে পারে না। কারণ ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কারণ হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়। ভারত আকস্মিকভাবে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের দেশে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে মনে করছে কেউ কেউ। আবার অনেকেই মনে করছেন বাজারে সিন্ডিকেট রয়েছে, তারাও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে কাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারে পাঁচ কেজি দেশি পেঁয়াজ ক্রয় করতে হয়েছে প্রায় ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে ১০০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ দাম বেড়ে ৭০ টাকা পর্যন্ত হয়। যেখানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪০ এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকায় ক্রয় করা যেত।

বন্যার অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। চালের কোনো ঘাটতিও নেই। সব বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দুই থেকে ৫ টাকা। এভাবে মৌসুম শেষে নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সরকার মাঝারি ও সরু চালের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে। আলুর দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। কারণ এ বছর আলুর উৎপাদন ছিল অনেক বেশি। এমনকি মৌসুমের সময় আলু পচে যেতেও দেখছি। এখন আলু মানুষ কিনতে পারছে না। কারণ যে আলু গত বছর ২৫ টাকায় ক্রয় করছি, সেই আলু ৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এখন দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। আলু এমন একটি জিনিস যা সব মানুষের দরকার এবং সব তরকারিতে রান্না করার সময় প্রয়োজন হয়। দর নিয়ন্ত্রণে নানামুখী অভিযান চলছে। কিন্তু বাজারে গেলে দেখি আলুর দাম কমেনি এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখাচ্ছে।

এই পেঁয়াজ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ায় মাঝেমধ্যে সংকটে পড়তে হয়। এই জন্য আমাদের অনেক আমদানির উৎস বের করতে হবে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এই অবস্থায় পড়তে না হয়। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম স্থানে রয়েছে। তারপরও পেঁয়াজের সমস্যা মিটছে না। পেঁয়াজ, চাল এবং আলুর দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এছাড়াও অনেক তদারকি চলমান। কিন্তু কিছুতে বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এতে মনে হচ্ছে বাজার মনিটরিং এ ঘাটতি থাকতে পারে।

আমরা কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন পেঁয়াজ, আলু, চাল জোগান দিতে না পারার কারণের মূলে রয়েছে সংরক্ষণাগারের অভাব, পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, কৃষকরা সঠিক মূল্য না পাওয়া, বীজের সংকট, কৃষকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ না দেওয়া, পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়া, কৃষকের জন্য প্রণোদনা না থাকা ইত্যাদি। তবে এসব সংকট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন পেঁয়াজ ও চাল নিয়ে গবেষণা, নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি। কৃষকরা যাতে পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যের ন্যায্য দাম পায় সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ এবং মনিটরিং বাড়াতে হবে। এছাড়াও কৃষকের উৎপাদন খরচকে আমলে নিয়ে সব পণ্যর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি দাম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। সরকারকে কৃষকের সব সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ প্রত্যেক জেলায় একটি করে হিমাগার স্থাপনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারলে আলু, চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য কৃষি পণ্যর উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করি।

গুজব বা ভবিষ্যতে পণ্যর ঘাটতির আশঙ্কায় ক্রেতাদের অহেতুক অতিরিক্ত মজুত করার জন্য পণ্যর দাম বেড়ে যায় কোনো কোনো সময়ে। এছাড়াও সংকটের সময় একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পণ্যর দাম বাড়ানোর পেছনে কাজ করে থাকে। তাই এই ধরনের সংকট রোধে পেঁয়াজ আমদানির অনেকগুলো সাপস্নাই চ্যানেল ঠিক রাখা, প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, আমদানি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানো, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকরা, নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও অপ্রয়োজনীয় মজুতদারি বন্ধ করা, সাধারণ ক্রেতার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মজুত রাখাও বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও বাজারে দ্রব্যমূল্যর দাম বৃদ্ধি করতে যেসব সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

করোনাভাইরাসে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত এবং এই মহামারিতে গরিব, মধ্যবিত্তসহ প্রায় সব মানুষের আয় কমেছে। চিকিৎসা বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পেঁয়াজ, আলু, চালের মূল্যবৃদ্ধি মানে সব মানুষের ওপরই কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে মানুষের দুর্ভোগ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যারা চাকরিজীবী তারাই বাজারে গেলে হিমশিম খাচ্ছি, আর গরিব মানুষের কি যে করুণ অবস্থা হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বাজারে সিন্ডিকেট এবং

দ্রব্যমূল্যর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে গরিবের বেঁচে থাকাই দায়। যেভাবে হোক সরকারকে বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে গরিবের মুখে হাসি ফোটাতে হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মো. শফিকুল ইসলাম : সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে