শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

চিঠিকে দিও না বিদায়

নতুনধারা
  ০৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

প্রাণে প্রাণ মেলাতে আর হৃদয়ের গভীরতম কথাগুলো প্রিয়জনের কানে সঙ্গোপনে শুনিয়ে দেওয়াই চিঠির দায়িত্ব ছিল। অবাধ ইন্টারনেট আর প্রযুক্তির এই যুগে চিঠিপত্রের আবেদন যেন আর ধোপে টিকছে না। যুগের পর যুগ মানুষের আবেগ-ভালোবাসার কথাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ানোর মতো চিঠির খামে খামে পৌঁছে যেত আপনজনের হাতে। তীব্র অনভিলষণীয় সেই চিঠি টিমটিমে আলোতে খুব নিবিষ্টমনে বসে বারবার পড়ার যেই মহানন্দ সেই সব কাহিনী আজকাল শুধুই দাদা-দাদির মুখে মুখেই প্রচলিত। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখা যায় সেই পুরনো খাম থেকে আমার বাবার এবং তার বিনিময় করা চিঠিগুলো পড়তে। কখনো কেঁদে কেঁদে সাড়া আবার কখনো কখনো খুশিতে পাগলপারা। এসব আবেগের রসদ কিন্তু চিঠিই জোগান দিয়েছে।

আবেদন আকুঞ্চিত সেই চিঠিপত্র আজ কেবল পরীক্ষার খাতাতেই লিখতে হচ্ছে। এ দেশে বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্তই পরীক্ষার খাতায় মার্কস তোলার ক্ষেত্রেই চিঠিপত্র লিখতে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কারিকুলামে যা শেখানো হয় তা শেখানো হয় যাতে বাস্তবে চলতে গিয়ে কাজে লাগে কিন্তু বাস্তবতা এই বলে যে চিঠিপত্র আজকাল শুধুই পরীক্ষার খাতাই বন্দি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমাদের শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করতে হবে।' বাস্তবে আমরা চিঠির ব্যবহার করছি কি? অন্যদিকে কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন যথার্থই মনে করেন, প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে। প্রযুক্তির তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু চিঠির রয়েছে স্থায়িত্ব। এখানে আবেগও কাজ করে। ই-মেইলে মানুষের মানবিক জায়গাটা ধরা যায় না।

চিঠির বিপরীতে এসেছে উন্নত যোগাযোগ মাধ্যম। যেমন- ফেসবুক, ভাইভার, ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই নিজের মনের কথা কিংবা বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে। তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ প্রবাহ বিশ্বটাকে খুবই সংকুচিত করে দিয়েছে যাকে প্রচলিত ভাষায় বলা হয় 'বিশ্বগ্রাম'। এর সুফলের পাশাপাশি কুফলগুলোও খুবই গুরুত্ব ধরনের। তাই বলে কি চিঠির কোনো গুরুত্বই রইল না? দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, খাম ও ডাকটিকিট বিক্রি বিগত ১০ বছরে ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। বর্তমানে ডাক বিভাগের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত বৈদেশিক শাখার পার্সেল প্রেরণ।

আমরা খুব সহজেই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। খুব কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া বার্তাগুলো খুব কম সময়ই মনের স্টোরেজে থাকে অথচ চিঠিতে পাওয়া প্রত্যেকটা শব্দই যেন কতটা আবেগবিজড়িত, কতটা স্নিগ্ধ। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তার স্ত্রীকে যেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন সেটা কে না পড়েছে! আব্রাহাম লিংকনের তার পুত্রের শিক্ষকের প্রতি চিঠির কথাও অবিস্মরণীয়। চিঠিকে কেন্দ্র করে লেখা হয় কতশত গান আর কবিতা।

যুগ কতক আগেও ভালোবাসার প্রথম বহর পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম কিন্তু ছিল চিঠিপত্রই। কবি মহাদেব সাহার 'চিঠি দিও' কবিতার মতো এখন কেউ তার প্রেমিকার প্রতি আবেদন করে না 'করুণা করে হলেও চিঠি দিও,খামে ভরে তুলে দিও/আঙ্গুলের মিহিন সেলাই/ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো/অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।' সেই ভালোবাসাও যেমন আজ বিলীন তেমনি চিঠির আদান-প্রদানও ম্রিয়মাণ।

সময় এসেছে চিঠির ব্যবহার বাড়ানোর। একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগের কথা হয়তো অনেকেই জানি। চিঠি লেখার অভ্যাস ফেরানোর বার্তা দিতে উদ্যোগী হয়েছিল বর্ধমানের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ইংরেজির নতুন বছরে শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা-বার্তা ফোনে নয়, চিঠি লিখে জানাচ্ছে সংগঠনটি। সবুজায়নের লক্ষ্যে চিঠির সঙ্গে গাছের বীজও সেঁটে পাঠানো হচ্ছে। সেটি রোপণের অনুরোধ জানানো হচ্ছে চিঠিতে। এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন ডাক বিভাগের বর্ধমান আরএমএস শাখার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, 'প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে চিঠি লেখা অনেকটা কমে গিয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে এই প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে।' তাই মন খুলে বলব, চিঠিই পারে মনের মণিকোঠায় এঁকে দিতে দীর্ঘকালের মহাসত্য, ভালোবাসা।

নাবিল হাসান

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে