বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক

সংবিধানের মতো পবিত্র বিষয়কে দেশের সর্বত্র বাস্তবরূপে ছড়িয়ে দিতে কোনো দিবসের প্রয়োজন নেই। ঐতিহাসিক নিয়ম রক্ষার অংশ হিসেবে না হয় হোক পালিত। তবে বাকি ৩৬৪ দিনই প্রজ্বলিত শিখার মতো অটুট থাকুক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, আইনের কার্যকর শাসন এবং সঠিক বিচারব্যবস্থা এটাই কামনা।
অনন্য প্রতীক রাউত
  ০৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

সংবিধান একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য আয়নাস্বরূপ। রাষ্ট্র পরিচালনার সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় সংবিধানের বিধি মোতাবেক। সংবিধানের ধরন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। কোথাও লিখিত, কোথাও অলিখিত। বিভাজন করতে চাইলে আরও করা সম্ভব। সরকারের বা রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন অনুযায়ী সংবিধান নানারকম রূপে আবর্তিত? ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর অল্প সময়ে বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান যাত্রা শুরু করে। এপ্রিল ১৯৭২-এ ড. কামাল হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। সংবিধান লেখার পর এর বাংলা ভাষারূপ পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মাজহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার ভার দেয়া হয়। নানা পর্যালোচনা এবং অধিবেশনের পর সংবিধান চূড়ান্ত হয়। যেখানে গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্য স্বাক্ষর করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান চূড়ান্তভাবে প্রণীত হয়। সেই সূত্র ধরেই ৪ নভেম্বর ছিল সংবিধান দিবস।

বিজয়ের ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় বাংলাদেশের সংবিধান। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণের পাশাপাশি সংবিধান প্রণয়ন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অবশ্যই। যা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সহযোগিতায় সহজেই উতরে যায় বাংলাদেশ। সংবিধান হিসাবে আদর্শ একটি সংবিধান বাংলাদেশের সংবিধান এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। জনগণের মৌলিক অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে খুব ভালোভাবেই। বৈশিষ্ট্যর দিক থেকে বিবেচনা করলে- আমাদের সংবিধানের লিখিত সংবিধান, অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১৫৩, তফসিল ৪, ভাগ ১১, প্রস্তাবনা একটি। সময়োপযোগী তথা যুগোপযোগী আইন সৃষ্টি এবং সময়ের সঙ্গে পালস্না দিতে সংবিধান সংশোধন করা জরুরি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর সাম্প্রদায়িক, দেশদ্রোহী নানা অপশক্তি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নিজ ইচ্ছামতো পবিত্র সংবিধানকে করেছে কলঙ্কিত। প্রণয়ন করেছে 'ইনডেমনিটির' মতো কালো আইন। পাশাপাশি, সুকৌশলে সংবিধানে নানা ধারায় স্থান দেওয়া হয়েছে অনৈতিক তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধ চেতনা বিবর্জিত বিষয়। ক্ষুণ্ন করা হয়েছে জনগণের মৌলিক অধিকার, ধ্বংস করা হয়েছে ভোটাধিকারের মতো অতীব প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অধিকার।

পরে সুস্থ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত হলেও রয়ে যায় সেই অস্বাভাবিকতা। যার খাদ থেকে আজও বাংলাদেশ পুরোপুরি বের হতে পারেনি। অন্যদিকে, অশিক্ষা বড় একটি কারণ, সাংবাদিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে। অথচ দেশের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণের কথার যৌক্তিক প্রতিফলন রয়েছে সংবিধানে। অন্যদিকে প্রভাবশালী মহল এবং রাজনৈতিক দখলদারিত্ব বা আধিপত্য বিস্তারকারী মনোভাবের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন হচ্ছে সংবিধানের মর্যাদা। এমনকি, সমাজের 'ক্যান্সারস্বরূপ' এ সব লোক প্রশাসন পুলিশকেও নিয়েছে পকেটে। দিন যত এগোচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের টিকে থাকা ততদিন কঠিন হচ্ছে বা বত্তের মধ্যে আটকে যাচ্ছে। তারা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন কোনোভাবেই করতে পারছে না। অথচ দেশকে স্বাধীন করার বড় কারণ ছিল এ সব দুঃখী সন্তানদের মুখে হাসি ফুটিয়ে শিক্ষা ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো। যাতে এগিয়ে যায় সবুজ, শ্যামলময় বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার মতামত অশিক্ষা দূরীকরণের ব্যাপারে মানুষকে অনুপ্রেরণা প্রদান করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের দূরদর্শিতার অংশ হিসেবে সেই অনুপ্রেরণার মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেটা ইতিবাচক সংবাদ। প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দরুন কাজটি সহজ, নির্মল হয়েছে। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি! প্রাথমিক শিক্ষার যেমন অগ্রগতি হচ্ছে তেমনি সাধারণ মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা অতীব জরুরি। আর গ্রামের মোড়ল কালু মিয়ারা যেন হুক্কা বা সিগারেটে টান মেরে বলতে না পারে আজ থেকে তোর এ সব আমার। কোনো প্রভাবশালীর চক্করে যেন সর্বস্ব হারাতে না হয় হারাধন বাবুদের বা মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার যেন পায় রিকশাচালক রশিদ মিয়ারা তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের পরিপূর্ণ শাসন। লঙ্ঘন হবে না মানবাধিকার, সমাজ হবে শান্তি, সমৃদ্ধির নীড়।

সংবিধানের মতো পবিত্র বিষয়কে দেশের সর্বত্র বাস্তবরূপে ছড়িয়ে দিতে কোনো দিবসের প্রয়োজন নেই। ঐতিহাসিক নিয়ম রক্ষার অংশ হিসেবে না হয় হোক পালিত। তবে বাকি ৩৬৪ দিনই প্রজ্বলিত শিখার মতো অটুট থাকুক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, আইনের কার্যকর শাসন এবং সঠিক বিচারব্যবস্থা এটাই কামনা।

আইনের শাসনে বাংলাদেশ হোক রোল মডেল। আইন মেনে চলা, অধিকার ভোগ এবং কর্তব্য পালন করে প্রত্যকের হওয়া উচিত আদর্শ নাগরিক। এক এক করে একদিন সবাই হবো আদর্শ নাগরিক, ছড়িয়ে পড়বে আদর্শ সংবিধানের বাস্তব সু-বাতাস এটাই প্রত্যাশা। প্রত্যাশার ফল কতটা বাস্তবরূপ নেয় বা এ যাবতকালে দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে কিনা সেটাই ভাবনার মতো বিশাল বিষয়বস্তু।

অনন্য প্রতীক রাউত : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে