শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের স্মার্টফোন আসক্তি থেকে বাঁচান!

মোহাম্মদ শাহিন শিক্ষার্থী ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  ০৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

সপ্তাহ খানেক আগেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম। সেখানে দেখলাম, ৬ বছরের ছোট্ট মেয়ে মারিয়া (ছদ্মনাম), সব সময়ই হাতে তার একটি স্মার্টফোন। তার মাকে জিজ্ঞেস করতেই বিষণ্নমনে বলল, দিনের অধিকাংশ সময়জুড়ে তাকে ভিডিও, কার্টুন কিংবা মোবাইল গেম খেলতে না দিলে পড়াশোনা করতে চায় না, খাবার খেতে চায় না, রাগারাগি করে, কোনো কথাও শোনে না। এ চিত্র যে শুধুই এই পরিবারের; তা নয়- বরং তা গোটা দেশের অধিকাংশ পরিবারেরই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়- যেই বয়সের একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা অর্জনে খেলাধুলা কিংবা শারীরিক কসরতে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল; সেই বয়সের একটি শিশু আজকাল স্মার্টফোন আসক্তিতে নিমগ্ন থাকে। আজকাল কোনো রেস্টুরেন্ট, দাওয়াতের জায়গা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডারত অবস্থাতেও শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোন আসক্তি যেন পিছু টানে না। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মধ্যে স্মার্টফোন আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় প্রভাবশালী কারণ আজকালকার অভিভাবকরা সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বিভিন্ন ভিডিও, কার্টুন কিংবা গেমসের মাধ্যমে ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের শান্ত রাখতে হয়। অনেক অভিভাবকই নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে নিজের চোখের সামনে রাখতে মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। অনেকে কর্মস্থলে ব্যস্ততার দরুনও শিশুকে সময় দিতে না পেরে স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ হাতে তুলে দিয়ে থাকেন। একটা সময়ে শহরাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে এ আসক্তি বিদ্যমান থাকলেও এখন শুধু শহরাঞ্চল নয়; গ্রামীণ পর্যায়ের শিশুদের মধ্যেও এ বিষফোড়া জন্মলাভ করেছে। শহরাঞ্চলে বাবা-মা কর্মস্থলে ব্যস্ততার দরুন শিশুদের হাতে স্মার্টফোনের ছোঁয়া দিত। আমাদের গ্রামীণ নারীরা আগে শুধু সন্তান লালন-পালন ও ঘরের কাজেই লিপ্ত ছিল। বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ গ্রামীণ নারীরাও দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, নিযুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে। যার ফলে বর্তমান যুগের একজন মা আগেকার যুগের একজন মায়ের মতো শিশুদের সময় দেওয়া কিংবা দেখাশোনা করাটা বহুলাংশে কমে এসেছে। ফলে অনেক বাবা-মা-ই সন্তানের হাতে স্মার্টফোনের ছোঁয়া দিচ্ছেন। তা ছাড়া, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার দরুন আধুনিক সেবা পৌঁছে যাওয়ায় গ্রামীণ সমাজের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরাও স্মার্টফোনের আওতায় এসে আসক্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক করোনার প্রেক্ষাপটেই আমরা দেখতে পাই- সাত মাসে আগেও যে শিশু-কিশোরের হাতে স্মার্টফোনের দেখা মেলা ছিল ভার, আজ তার হাতে রয়েছে চকচকে নতুন একটি স্মার্টফোন। এটি যে শিশুরা শুধু অনলাইন ক্লাসে ব্যবহার করছে তা নয়- বরং অবসরের দীর্ঘকায় সময়গুলোতে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও, ফেসবুকিং কিংবা মোবাইল গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে- পাশের বাড়ির রাকিব (ছদ্মনাম)। ক্লাস ৯-এ পড়ে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে এলাকায় তার মতো দুরন্তপনা ছেলে কেউ ছিল না। কিন্তু করোনার প্রেক্ষাপটে অনলাইন ক্লাসের কারণে সে হাতে পেল একটি স্মার্টফোন। এখন তাকে এলাকার কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কিংবা খেলার মাঠে তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুদের শান্ত রাখা, খাওয়ানো কিংবা বর্ণমালার শিক্ষাবিষয়ক কাজে অভিভাবকদের স্বস্তি এলেও বিপরীতে শিশুদের মধ্যে এভাবেই বাড়ছে স্মার্টফোন আসক্তি। ফলে শিশু-কিশোরের মধ্যে বাড়ছে নৈতিক স্খলন ও সামাজিক অবক্ষয়, যার দরুন বিপথে পা বাড়াচ্ছেন সে নজিরও অজস্র। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন- স্মার্টফোন বা প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ একটি আসক্তিমূলক আচরণ। এর অর্থ দিনকে দিন আরও বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে চাইবে। আর শিশু-কিশোর স্বভাবতই কৌতূহলপ্রবণ; তাই ভুলক্রমে একবার তাদের হাতে ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কিংবা স্মার্টফোন তুলে দিলে সহজে ছাড়ার পাত্র তারা নয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন- স্মার্টফোন আসক্তি শিশুর কর্মদক্ষতা ও সৃজনশীলতা হ্রাসের পাশাপাশি সৃষ্টি করে দৈহিক ও মানসিক সমস্যার। স্মার্টফোন বা গেমিং আসক্তির কারণে মানুষের আবেগ কমে যায়, রাগ ও হতাশা বৃদ্ধি পায়, সৃষ্টি হয় অনিদ্রার, মেজাজ খিটখিটে, রক্তের চাপ এমনকি হার্ট অ্যাটার্কের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। অনেকদিন দীর্ঘ সময় মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে শিশুর চোখেরও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে শিশুর পরবর্তী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করছে স্মার্টফোন। সুতরাং এটিকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একটি শিশুর সুন্দর, নিরাপদ ও বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ গড়তে অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলেন- স্মার্টফোন আসক্তি একটি মানসিক রোগ। এটি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের (ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ ইত্যাদি) আসক্তির মতোই। পার্থক্য হলো একটি আচরণগত আসক্তি অন্যটি নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি। তাই আপনার সন্তান যদি এতে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি হয়ে পড়ে তাহলে দ্রম্নত কোনো সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিন। আপনার ছোট্ট বাচ্চাটি যেন স্মার্টফোনের নাগাল না পায় সেদিকে কড়া নজর রাখুন। স্মার্টফোন ব্যবহারের জন্য অনুপযোগী হলে সন্তানের হাতে কখনোই স্মার্টফোন তুলে দেবেন না। একান্তই যদি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন সে ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দিন, তার সঙ্গে চুক্তিতে আসুন। বাসা-বাড়ির কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনটি সন্তান যেন আপনার সামনেই ব্যবহার করে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। সময় করে শিশুকে নিয়ে বিভিন্ন পার্ক বা কোথাও বেড়াতে যান। ছোট্টবেলা থেকেই শিশুর হাতে স্মার্টফোনের পরিবর্তে বিভিন্ন গল্প বা উপন্যাসের বই তুলে দিন। শিশুদের মধ্যে বেশি বেশি বই পড়ার অভ্যাস যেন গড়ে ওঠে তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করুন। খেলার মাঠের প্রতি তাদের প্রবল উৎসাহ দিন। ছবি আঁকাসহ বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতি শিশুদের মনোযোগী করান। এতে একদিকে যেমন আপনার সন্তান স্মার্টফোন আসক্তির মতো মানসিক রোগ থেকে রক্ষা পাবে অন্যদিকে আপনার সন্তানের মানসিকতা, সৃজনশীলতা, মেধা ও মননশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। তাই অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা দরকার, আসুন একটু সচেতনতার মাধ্যমেই আপনার শিশুর সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে