নদীর জন্য ভালোবাসা জাগুক হৃদয়ে

আমাদের কিছুসংখ্যক লোকের অবহেলার জন্য সব মানুষ কষ্ট করুক তা হতে পারে না। নদনদী পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা আমার ও আপনার সবার দায়িত্ব।

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

ওসমান গনি
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে রয়েছে অসংখ্য নদনদী। যেমন- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী। আর নদীগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মরতে বসেছে। আবার অনেক নদনদী হয়ে গেছে বিষাক্ত। নদীর বিষাক্ত পানি হয়েছে মানুষের জন্য ভয়ংকর। ঢাকা আমাদের বাংলাদেশের রাজধানী। আর এ ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। এক সময় বুড়িগঙ্গার অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে সবাইকে। কিন্তু কালক্রমে ঢাকা বিস্তৃত হলেও ক্ষয় হয়েছে বুড়িগঙ্গার। নাব্য হারিয়ে কমে গেছে পানির প্রবাহ। এখন বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে দূষণের নদীতে। আর পরিবেশের এই দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটি মানুষের আক্রমণের শিকার। দখল, ভরাট, আবর্জনা নিক্ষেপ ইত্যাদির কারণে নদীগুলো তাদের গতি ও ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। এগুলো স্রোতহীন হয়ে আবর্জনার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে। ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদী শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা প্রায় একই দশায় পড়েছে। এগুলোতে পানির চেয়ে বর্জ্যই বেশি। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে এ নদীগুলোর পানি ও রং হারিয়ে ফেলেছে। বর্জ্যের মিশ্রণে নদীগুলোর পানি কালো, নীল বা লাল হয়ে গেছে। এ চার নদীকে সরকার 'প্রতিবেশ সংকটাপন্ন' ঘোষণা করেছে। আর বিশ্বব্যাংক বুড়িগঙ্গাকে অভিহিত করেছে 'মরা নদী' নামে। চামড়া শিল্পের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষিত করে চলেছে প্রতিনিয়তই। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এতটাই দূষিত যে, এসব নদীর পানি এখন শোধনেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মনে ও মগজে প্রায়ই নদীর চলাচল টের পাই। সেই নদীর, যে নদীতে আমরা কাটিয়েছিলাম জীবনের হলুদ এক বিকাল। নাম জানি না সে নদীর, রূপ জানি! বাংলার প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার জুড়েই তো সেই রূপ, সুরের ধারা। আমার সেই বিকাল সুখ হয়তো নদীর কাছে চিরঋণী করে রাখে আমাকে। তাই নদীর কথা ভাবি। আমরা জলের মানুষ, আমাদের সব কিছুই নদীকেন্দ্রিক। নদী গানের জন্ম দেয়, নদী কবিতার জন্ম দেয়। আনন্দ-বিরহের-ভালোবাসার সাক্ষী নদী। নদীর তীরেই গড়ে ওঠে যান্ত্রিক জীবন, শিল্প-কারখানা, এসব শিল্প-কারখানা আবার আমাদের অর্থের জোগান দেয়। বলা চলে, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচে। কিন্তু কি করছি আমরা! কীভাবে শোধ করছি নদীর ঋণ? আমরা কাজ করছি বহমান নদী প্রকৃতির বিরুদ্ধে। তাই চাওয়া, কোনো যান্ত্রিক নিয়ম নদীকে না বাঁধুক! নামের মতোই সুন্দর বয়ে চলুক আমার আন্ধার মানিক, আমার ধানসিঁড়ি, আমার ভৈরব, কর্ণফুলি, সন্ধ্যা। সুগন্ধি ছড়াক সুগন্ধা। ভালো থাকুক আমার সুখের সেই নাম না জানা ছোট নদীটিও। তার চলাচল যেন টের পাই জীবনভর, কথা বলি তার সঙ্গে। আমরা স্স্নুইসগেট বসিয়ে নদীর আপন গতি থামিয়ে দিতে চাইছি, তথাকথিত সাময়িক উন্নয়নের নাম দিয়ে। এসব বাঁধ, স্স্নুইসগেট নির্মাণে আমাদের সহায়তার নামে ঋণ দিচ্ছে বিভিন্ন উন্নত দেশ। দিনের পর দিন আমরা শুধু ঋণের বোঝা টেনে চলেছি। যা দেশের জন্য যেমন অমঙ্গল বয়ে আনছে এবং ধ্বংসও করছে আমাদের দেশের সুন্দর প্রকৃতিকে। এমন তো কখনো হয়নি, যে কোনো বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বাঁধ ভাঙার জন্য আমাদের সহায়তা করেছে! আসলে সবই তাদের বাণিজ্যিক লাভের কৌশল মাত্র। উদাহরণ সেই বিল ডাকাতিয়া। শুনতে ডাকাতিয়া নদীর নামের মতো শোনালেও বিল ডাকাতিয়ার ইতিহাস বলে অন্য কথা। খুলনা জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বিলটি আশির দশকে স্থানীয় মানুষের জন্য অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়। \হকেননা, ষাটের দশকে উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে যে পোল্ডার তৈরি করা হয়েছিল তার অভ্যন্তরে সৃষ্টি হতে থাকে জলাবদ্ধতা। পানি নিষ্কাশনের কোনো জায়গা না থাকায় জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিল সংলগ্ন হাজার হাজার মানুষ। পানির তলে হারিয়ে যায় ধান, কৃষি পণ্যসব সবকিছুই। এ অবস্থায় মানুষের জীবন-জীবিকা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বিল ডাকাতিয়া তখন ছিল এক বিচ্ছিন্ন জনপদের নাম। হিসাব তো সহজ! যখন আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়াই প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যান্ত্রিকতা কী খুব বেশি দিন টিকতে পারে? আমাদের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাকে কেন্দ্র করে কত শত শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কত মানুষের আর্থিক জোগান দিচ্ছে এই নদীরা কিন্তু আমরা কী দিচ্ছি? বিষ? শিল্প-কারখানার বর্জ্য ছাড়া আর কিছু না; কিন্তু কেন? হয়তো অজ্ঞতা বা আমাদের অসচেতনতা। আমরা এতটুকু দৃষ্টি ফেরালেই নদীরা ফিরে পায় আপন ধারা। তাই চাওয়া, কোনো যান্ত্রিক নিয়ম নদীকে না বাঁধুক! নামের মতোই সুন্দর বয়ে চলুক আমার আন্ধার মানিক, আমার ধানসিঁড়ি, আমার ভৈরব, কর্ণফুলি, সন্ধ্যা। সুগন্ধি ছড়াক সুগন্ধা। ভালো থাকুক আমার সুখের সেই নাম না জানা ছোট নদীটিও। তার চলাচল যেন টের পাই জীবনভর কথা বলি তার সঙ্গে। বর্তমানে আমরা হারাতে বসেছি নদী মাতৃকার সেই সব ঐতিহ্যবাহী নদীগুলো। যার চারিপাশে রয়েছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগের মতো নদী। প্রতিনিয়ত পরিচর্যায় হতে পারতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ভরপুর এক শ্রেষ্ঠ রাজধানী। যার অবস্থান বর্তমানে পৃথিবীর দূষিত শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এ ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি, সামাজিকতা সবদিক বিবেচনায় পদক্ষেপ না নিলে দুরূহ পরিণতি যে অবধারিত, তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকার নদী এখন অসুস্থ ও মৃতপ্রায়, এটার নাব্য ফিরিয়ে আনতে পুনরায় খননের বিকল্প নেই। ঢাকার নদীকে বাঁচাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যেহেতু পানির আরেক নাম জীবন আর ওয়াসা বুড়িগঙ্গার পানিকে শোধন করেই রাজধানীবাসীকে সরবরাহ করছে। সেহেতু আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে দূষণমুক্ত নদী, এমনকি রাজধানীকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে নদী বাঁচিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারেব। এ বিষয়ে আমাদের বর্তমান সরকারের কার্যকর ভূমিকা আরও গতিশীল হবে বলে দেশের বিশিষ্ট্যজনরা মনে করেন। নদীকে দূষণমুক্ত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি আমাদের দেশের সচেতন মহল কেও এগিয়ে আসতে হবে। আইন করে দেশের কোনো সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব না। আইনের প্রতি আমাদের সবাইকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে আগে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের কিছুসংখ্যক লোকের অবহেলার জন্য সব মানুষ কষ্ট করুক তা হতে পারে না। নদনদী পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা আমার ও আপনার সবার দায়িত্ব। ওসমান গনি: কলাম লেখক