অস্থির ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজে আমাদের বসবাস

আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি- যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ, এর পূর্ণতা লাভ করে সামাজিক সুস্থতা ও বন্ধনের মাধ্যমে। সমাজব্যবস্থা এমনই হওয়া উচিত, যাতে ব্যক্তির স্বপ্ন ভঙ্গ ও জীবন বিপন্ন না হয়। অথচ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে। হেন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না।

প্রকাশ | ২৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
সমাজের স্বাভাবিক ও সুস্থ গতিপ্রবাহ রক্ষা করার দায়িত্ব কার, সরকার, স্থানীয় সরকার, সমাজপতি নাকি সমাজের সচেতন মানুষের। সমাজ পুনর্নির্মাণের দায়িত্বই বা কার? আপাতঃদৃষ্টিতে এসব প্রশ্ন সহজ মনে হলেও এর সমাধান বেশ জটিল। সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বসবাস করে, বিচিত্র এদের মানসিকতা ও রুচি। এদের কোনো সমান্তরাল ছাউনির মধ্যে আনা কঠিন। তবে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক অপরাধ কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে। সমাজ রক্ষা করা না গেলে পরিবার রক্ষা করা যাবে না, ব্যক্তিকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা করা জরুরি। সমাজ পরিবর্তন মানে সামাজিক কাঠামো ও সমাজের মানুষের কার্যাবলি এবং আচরণের পরিবর্তন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে, বিশৃঙ্খল সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি- যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ, এর পূর্ণতা লাভ করে সামাজিক সুস্থতা ও বন্ধনের মাধ্যমে। সমাজব্যবস্থা এমনই হওয়া উচিত, যাতে ব্যক্তির স্বপ্ন ভঙ্গ ও জীবন বিপন্ন না হয়। অথচ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে। হেন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে অবলীলায় হত্যা করছে। প্রেমের কারণে অর্থসম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা নিঃসঙ্গতা বঞ্চনা অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা-মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেয়ার নিমিত্তে নিজের সন্তানকে হত্যা পর্যন্ত করছে। পারিবারিক বন্ধন স্নেহ, ভালোবাসা মায়া-মমতা, আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ। এর পাশাপাশি সমাজে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও নারী নির্যাতন অবমাননা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির। আসলে আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এমনকি যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্রও নিরাপত্তাদানে অপারগ। আমরা নানা রকম সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নিধার্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কী সামাজিক ক্ষেত্রে, কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- সবক্ষেত্রেই অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি- যা একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা স্বাধীন ও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কল্পনা করতে পারছি না। এ অবক্ষয় ইদানীং আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে এবং সমাজ কাঠামোকে নড়বড়ে করে ফেলছে। সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যা বতর্মান সমাজে প্রকট। সামাজিক নিরাপত্তা আজ ভূ-লুণ্ঠিত, এমনকি ব্যক্তি নিরাপত্তাও প্রশ্নের সম্মুখীন। দেশের সামগ্রিক যে অবক্ষয়ের চিত্র এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই কি আমাদের খোলা নেই? আমাদের অতীত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, বর্তমান অনিশ্চিত এবং নিরাপত্তাহীনতার দোলাচলে দুলছে এবং ভবিষ্যৎ মনে হচ্ছে যেন পুরোপুরি অন্ধকার। যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় চলছে, চলছে তারুণ্যের অবক্ষয়- এর কী কোনো প্রতিষেধক নেই? করোনাকালে আমাদের তরুণরা হতাশ ও দিশাহারা। লেখাপড়া শিখেও তারা চাকরি পাচ্ছে না। ফলে অনেকেই ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ খুন-ধর্ষণের মতো, ডাকাতির মতো অমানবিক এবং সমাজবিরোধী কাজেও জড়িয়ে পড়ছে। কেউবা হয়ে পড়ছে নানা ধরনের মাদকে আসক্ত। অনেকেই আবার সন্ত্রাসীদের গডফাদারদের লোভনীয় হাতছানিতে সাড়া দিয়ে সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? দায়ী আমরাই। আমরাই তাদের সুপথে পরিচালিত করতে পারছি না। এর পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দখল ও দলীয়করণের ব্যাপারটি তো দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে কে আমাদের পরিত্রাণ দেবে এবং কে-ইবা আমাদের পথ দেখাবে? নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যদি নৈতিক হয় তা হলে সন্তানরাও নৈতিক ও মানবিক হয়ে উঠবে। সামাজিক মূল্যবোধ আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা সাম্প্রতিক নানা অপরাধমূলক ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত হয়। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি ধর্ষণ হত্যার মতো বিপজ্জনক অপরাধমূলক প্রবণতা সমাজে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা প্রতিরোধের প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। এই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার ও সমাজকেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির বর্বর পাষন্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। এমনকি শিশুর জীবনও চলে যাচ্ছে আপনজনের হাতে। এ সব রোধ করতে না পারলে একদিকে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরাও থাকবে নিরাপত্তাহীন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। সুতরাং সময় থাকতেই সাবধান হওয়া সমীচীন। এই অবক্ষয়ের আরেক চিত্র- ইদানীং সমাজে শিশু হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া। আমাদের কোমলমতি শিশুরা কোনো দিক থেকেই এখন আর নিরাপদ নয়। নানা কারণে তাদের জীবনঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে। কখনো তারা দুঘর্টনায় মারা যাচ্ছে অথবা অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার মতো নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে, আবার কখনো তারা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অপার সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে যে শিশুর নিরাপদে বেড়ে ওঠার কথা সেখানে কেন তাদের অকালে মৃতু্য হবে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কী কোনো ভূমিকা নেই? বিয়ের পর একজন নারীর সবচেয়ে ভরসাস্থল ও নিরাপদ জায়গা হচ্ছে তার স্বামী। সব ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক বৈরী পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে রাখার কথা যে স্বামীর, যে স্ত্রীর স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা একজন স্বামীকে ঘিরে, সেই স্বামীই হয়ে ওঠে লোভী, ভয়ংকর, নির্যাতক, শোষক ও হন্তারক। নারীর সবচেয়ে নিরাপদ নিভর্রতার জায়গা যখন সংকোচিত হয়ে পড়ে কিংবা থাকে না তখনই নারী দিশাহারা হয়ে পড়ে। 'এ জীবন বাঁচিয়ে রাখা কিংবা নিজে বেঁচে থাকা নিরর্থক'- এ বোধ যখন নারীর মধ্যে জন্ম নেয় তখনই সে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথে যাত্রা করে। আমি এর আগেও বলেছি সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত ত্যাগ ও সংযম প্রদর্শনের জায়গা। দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। একে অপরের সঙ্গে স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে খাপ খাইয়ে নেয়ার মধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সফলতা নিভর্রশীল। সে ক্ষেত্রে স্বামীই যদি হয়ে ওঠে যৌতুকলোভী, নিযার্তক ও অমানুষ তাহলে স্ত্রীদের সংসারে আর দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। অথচ স্বামীর উচিত যে কোনো ধরনের বিপদে, নানান প্রতিকূল পরিবেশে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ান। তাকে ভরসা দেয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সম্ভাবনার জাল বুনিয়ে মোহাবিষ্ট করে রাখা, তাকে শোষণ নিযার্তনের মাধ্যমে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়া নয়। একজন স্বামী যখন তার নতুন বউকে ঘরে তোলে যৌথ পরিবার হলে তার কাজকর্ম, আচার-আচরণ, চলাফেরা পরিবারের অন্য সদস্যদের পছন্দ নাও হতে পারে। তারা ওই নববধূর বিরুদ্ধে যে কোনো মুহূর্তে রুখে দাঁড়াতেও পারে। কিন্তু সব কিছু থেকে আগলে রাখার দায়িত্ব একমাত্র স্বামীর। স্বামী যদি তার বাবা-মা ভাইবোনসহ অন্য আত্মীয়কে প্রশ্রয় দেয় তার স্ত্রী নির্যাতনে, শোষণে কিংবা বঞ্চনায় তাহলে পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুরতা, শোষণ, নিযার্তন, দুর্ব্যবহার ওই স্ত্রীর ওপর বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে আমরা দেখতে পাই স্বামীর চোখের সামনে তার স্ত্রীকে পরিবারের সবাই মিলে নিযার্তন করছে, কিন্তু স্বামীধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। কিছুই বলছে না। ক্ষেত্র বিশেষে স্বামী নিজেও পরিবারের অন্যান্যের সঙ্গে নির্যাতনে শরিক হচ্ছে। তখনই নারী বুঝে ওঠে তার শেষ ভরসার জায়গাটিও অধিকতর নড়বড়ে। আর এক্ষেত্রেই নারীর জিদ ও হতাশা বহুগুণে বেড়ে যায়, বেঁচে থাকাকে অথর্হীন মনে করে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না। কূপমন্ডূকতা যেমন আমাদের সমাজকে দিন দিন গ্রাস করছে। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণেই মূলত এমনটি হচ্ছে। রাষ্ট্রের মধ্যে শৃঙ্খলা না থাকলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে এটাই স্বাভাবিক, যার কারণে সামাজিক অবক্ষয় এত চরমে পৌঁছেছে। রাজনীতি তার আদর্শ হারিয়েছে অনেক আগেই। আদর্শ ও গণমুখী রাজনীতি দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্ত অপরাধী পরিবেষ্টিত রাজনীতি। ক্ষমতা ও পেশিশক্তির বলে রাজনীতিকরা হেন কোনো অপরাধ নেই যে তারা করছেন না। এর প্রভাব পড়ছে সমাজে। ফলে সামাজিক অপরাধ তীব্র হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ এবং সামাজিক আন্দোলন বেগবান হলেই এর থেকে মুক্তি মিলতে পারে, অন্যথায় নয়। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক