শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শারদীয় দুর্গোৎসবের তাৎপর্য

নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন রুখে দিয়ে মাতৃরূপে ভক্তি ও সম্মানের দৃষ্টিতে সাম্যের পৃথিবী গড়তে হবে। তাহলেই কেবল সমাজ সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে। দেবী দুর্গা মানুষের চিত্ত থেকে যাবতীয় দীনতা ও কলুষতা দূরীভূত করে শুভ ও ন্যায়ের উদাত্ত আহ্বান জানান সবাইকে। সত্যি বলতে, বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে করোনা নামক মহামারি পুরো বিশ্বকে কিছুটা হলেও থামিয়ে দিয়েছে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ২৬ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

এক সময় দেবতাদের স্বর্গরাজ্য অসুররা অধিকার করে নেন। তখন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। দেবী দুর্গা অসুরদের বিনাশ করেন। দেবতারা ফিরে পান তাদের স্বর্গরাজ্য। অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার জন্যই 'মা' আনন্দময়ী দেবী দুর্গার আগমন। অশুভ শক্তির উত্থানকে বিনাশ করে তিনি সব দুঃখ, দুর্গতি, ভয় নাশ করেন। অন্যায়ের বিনাশ ঘটিয়ে সজ্জনদের প্রতিপালনের অঙ্গীকার নিয়ে মানুষের মধ্যে নৈতিক আদর্শ জাগ্রত করার জন্যই দেবীর আগমন ঘটে থাকে। যেখানে শুভ, শান্তি, ঐক্য আর কল্যাণের পরাজয় হয় সেখানেই ঘটে অসুরের আবির্ভাব। আর তখন সম্মিলিত শক্তি ছাড়া অসুরের বিনাশ করা ছিল অসম্ভব। লোভ-লালসা, অহঙ্কারসহ সব ধরনের মন্দ কাজ যেন এক একটি অসুর। তাই আমাদের হৃদয়ে অশুভ শক্তির ছায়া দূর করতে হবে। নিজের ভেতরকার এমন সব অসুরসহ চারপাশের অসুরদের সম্মিলিতভাবে দমন করতে হবে।

এবার মা দুর্গা দূর কৈলাশ ছেড়ে পিতৃগৃহে আসবেন দোলায় এবং প্রস্থান করবেন গজে। পৌরাণিক কাহিনি মতে, মা দুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার পর সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন; সেই থেকে শরৎকালে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। দুর্গা হচ্ছেন তিনি, যিনি জীবের তথা দেবতাদের দুর্গতি নাশ করেন, আবার দুর্গম অসুরকে বধ করেন। শরৎকালে অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সব দেব-দেবীর মতো দেবী দুর্গা বিষ্ণুমায়া নিদ্রিত থাকেন। শারদীয় দুর্গাপূজায় বোধন হচ্ছে নিদ্রিত দেবীকে জাগ্রত করা। শরৎকালে অকাল বোধনের দ্বারা দেবীকে জাগ্রত করা হয় বলে দুর্গার অপর নাম শারদীয়া। শরৎকালে এই দুর্গাপূজা হয়, তাই তাকে শারদীয় দুর্গাপূজা বলা হয়। চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় দেবী মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্যে ফিরিয়ে দেন এবং দুর্গতির হাত থেকে জীবকে রক্ষা করেন, তিনিই মা দুর্গা। দেবীর ডানে লক্ষ্মী ও গণেশ, বামে সরস্বতী ও কার্তিক। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি জীবের দুর্গতি হনন করেন। আরেকটি অর্থ দুর্জয়া। রাজ্যভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গা আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ২৪ অধ্যায়ে উলেস্নখ আছে। দেবী দুর্গা শক্তিদায়িনী। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটের সময় তিনি মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন নামে। তিনি তাই আদ্যশক্তি মহামায়া, ব্রহ্মসনাতনী। দুর্গা, মহিষাসুর মর্দিনী, শলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারি, চন্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবর্তী, কমলা, শিবানী, যোগনিন্দা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে।

শারদীয় দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো 'দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন', অর্থাৎ সব অশুভ শক্তি নির্মূল করার জন্যই পৃথিবীতে প্রতি বছর দুই বার দেবী দুর্গার আগমন প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী দেবী নামে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়- যা হিন্দু সম্প্রদায় বাসন্তীপূজা হিসেবে আরাধনা করে থাকেন। কিন্তু বাসন্তী পূজার ব্যাপকতা শরৎকালের আশ্বিন-কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার মতো আবেদন ও জাঁকজমকপূর্ণ হয় না। হিন্দু পুরাণে আছে রামচন্দ্র রাক্ষসরাজা রাবণকে বধ করার জন্য আশ্বিন মাসে মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন তখন থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর সারা বাংলাদেশের পূজার সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূজার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতার অন্যতম মূল্যবোধ ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারল না। তারপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার পরিচালনার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে ধারণ করে দেশ পরিচালনয় এক যুগান্তকারী উন্নয়নের ভূমিকা রাখছে বলেই সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করে যাচ্ছে, আর তারই সঙ্গে বেড়ে চলছে পূজার সংখ্যা। আরেকটি বড় কারণ হলো 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার' এটাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে আজ জনপ্রিয় স্স্নোগান হলো 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার'। এই স্স্নোগান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশ্বাসের সঙ্গে বলেন বলেই আজ এ স্স্নোগান সর্বমহলে এমনকি রাজনীতিবিদদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

রামচন্দ্র যে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন তার মর্মার্থটি সর্বাংশে ভুলে গিয়ে আমরা এর খোলসটি নিয়েই মাতামাতি করছি। শক্তির প্রতীক রূপেই দেবী দুর্গার কল্পনা করা হয়েছে। তাই দুর্গাপূজা মানেই হচ্ছে নিজের ভেতর সেই শক্তির সঞ্চার ঘটানো যে শক্তি দিয়ে সব অপশক্তিকে প্রতিহত ও নির্মূল করা যায়। ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র যেমন 'শস্য' তথা ধন- উৎপাদকদের সংগ্রামী নেতা রূপে সীতা-অপহরণকারী (অর্থাৎ উৎপাদক মেহনতি মানুষের উৎপাদিত সামগ্রীর লুণ্ঠনকারী) রাবণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য দুর্গাপূজা করেছিলেন (অর্থাৎ আত্মশক্তি লাভের সাধনা করেছিলেন), কলিযুগ বা বর্তমান যুগের প্রতিটি শোষিত ও বঞ্চিত মানুষকেও তো তা-ই করতে হবে। কারণ এ যুগেও তো রাবণরা প্রবল প্রতাপেই বিদ্যমান। এ যুগের রাবণদের সম্পর্কেই নজরুল বলেছেন, 'দশমুখো ওই ধনিক রাবণ, দশদিকে আছে মেলিয়া মুখ, বিশ হাতে করে লুণ্ঠন তবু, ভরে নাকো ওর ক্ষুধিত বুক।'

একালের এই রাবণদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব যে বর্তেছে আমাদেরই ওপর, সে কথা যেন আমরা ভুলে বসে আছি। অথচ প্রতি বছরই সাড়ম্বরে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। কিন্তু সে পূজায় প্রাণ প্রতিষ্ঠায় ও আত্মশক্তির জাগরণ ঘটানোয় পূজারিদের কোনো গরজ নেই। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিকে ধিক্কার জানিয়েই নজরুল একে 'পূজা-অভিনয়' আখ্যা দেন।

পূজাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব তা-ও উৎসবের মূলমর্মকে পরিত্যাগ করে হয়ে ওঠে বহিরঙ্গসর্বস্ব। কোথাও কোথাও তা নানা ক্লেদাক্ততা ও আবিলতায় একান্ত পঙ্কিলও হয়ে ওঠে। অবশ্য এ রকমটি যে কেবল একালেই ঘটছে, তা নয়। একালে বরং দুর্গোৎসবের অনেক বেশি গণায়ন ঘটেছে এবং তার ফলে ক্লেদাক্ততা ও আবিলতাও অনেক পরিমাণে প্রতিরুদ্ধ হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বহু লাখ টাকা ব্যয় করে শারদীয় দুর্গাপূজার সাড়ম্বর অনুষ্ঠান করেন। সেই থেকেই এই দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। তবে রাজা কংসনারায়ণ কেবল যে একটি ধর্মীয় ঐতিহ্যই সৃষ্টি করেছিলেন তেমন কথাও বলা যায় না। রাজার আসল উদ্দেশ্য ছিল ঐশ্বর্য প্রদর্শন। অর্থাৎ ঐশ্বর্যের দাপট দেখানো। সেই থেকে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ঐশ্বর্যশালীদের দাপট দেখানোর একটি অপ-ঐতিহ্যও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সেই ঐতিহ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তার উত্তরসূরিরা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গেই বহন করে যেতে থাকেন। তারপর উনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে যে নব্যধনী বা 'হঠাৎ নবাবদের' উদ্ভব ঘটে, তারা সে ঐতিহ্যকে আরো বেগবান করে তুলেন। অশ্লীল কদর্য নৃত্যগীত, মদ্যপান ও বেশ্যাগমন তাদের দুর্গাপূজার অপরিহার্য অনুষঙ্গী হয়ে পড়ে। ঐসব উপসর্গ যুক্ত হওয়ার পর পূজা ও উৎসব দুই-ই চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে যায়। এই চরিত্রভ্রষ্টতা দূর করা ও 'পূজা অভিনয়'কে অভিনয় মুক্ত করার জন্যই সচেতন জনগণের প্রতি নজরুলের আহ্বান। সে আহ্বানে জনগণকে সাড়া দিতেই হবে। অর্থাৎ একালের দুর্গাপূজা ও দুর্গোৎসবের মূল লক্ষ্য হতে হবে 'দশ মুখো ওই ধনিক রাবণদের উৎখাত করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি আহরণ করা। জনগণ সেই শক্তি প্রয়োগ করেই যে ওই রাবণদের 'বিশ হাতে লুণ্ঠন' করার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটাবে নজরুল সে ব্যাপারেও দৃঢ় প্রত্যয় ও সঙ্গত আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পৌরাণিক অনুষঙ্গ প্রয়োগ করেই তিনি জানান যে : ধন-উৎপাদক কৃষক-শ্রমিকদের মধ্য থেকেই রামচন্দ্রের মতো নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটবে এবং সেই নেতৃত্বই এ যুগের রাবণদের তথা শোষক-বঞ্চকদের উৎখাত ঘটাবে।

ধর্ম উৎসব মানুষে মানুষে প্রীতি, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ঐক্য ও শান্তির ডাক দিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও হানাহানি, লোভ-লালসা, অনৈক্য, অসহিষ্ণুতা ও নিষ্ক্রিয়তা আজ চারপাশে বিরাজমান। তাই সত্যের রক্ষাকর্তা ও দুষ্টের বিনাশকারিণী হিসেবে 'মা' আসেন শান্তির বার্তা নিয়ে। এ পূজা আমাদের সমগ্র জাতিসত্তায় মনুষ্যত্বের জাগরণ, মানবকল্যাণ তথা বিশ্ব কল্যাণের পূজা। বর্তমান বাস্তবতায় যে কল্যাণের নামে অকল্যাণ, ধর্মের নামে অধর্ম, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, পঙ্কিলতা- তা দূর করে শান্তি স্থাপন সবচেয়ে বেশি দরকার। শুধু মুখে নয়, কর্মের মাধ্যমে সত্যিকারের প্রেম, ভালোবাসা, মানবতা, ভক্তি, সম্প্রীতি বেশি প্রয়োজন। যতই আমাদের মধ্যে দেবী 'মা'র মাতৃভক্তির বিকাশ হবে ততই আমরা পবিত্র হব আর উন্নতির দিকে এগিয়ে যাব। এতে করে নারীরা যথার্থ মর্যাদা ও সম্মান পাবে।

নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন রুখে দিয়ে মাতৃরূপে ভক্তি ও সম্মানের দৃষ্টিতে সাম্যের পৃথিবী গড়তে হবে। তাহলেই কেবল সমাজ সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে। দেবী দুর্গা মানুষের চিত্ত থেকে যাবতীয় দীনতা ও কলুষতা দূরীভূত করে শুভ ও ন্যায়ের উদাত্ত আহ্বান জানান সবাইকে। সত্যি বলতে, বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে করোনা নামক মহামারি পুরো বিশ্বকে কিছুটা হলেও থামিয়ে দিয়েছে।

মা দুর্গার আগমনে মহামারিসহ সব ধরনের অনাচার ধুয়ে মুছে যাক- এটাই কামনা। মায়ের আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরো দৃঢ় হোক এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হোক। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকুক এবং শুভ শক্তির জয় হোক।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী; কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<116482 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1