বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজে কেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারছি না?

দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী প্রধান এলাকা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, বগুড়া ও লালমনিরহাট। এ সব এলাকায় কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বেশি উৎসাহ দিতে হবে।
বশিরুল ইসলাম
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি ভারত আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে। আর এতে দেশের বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করে। ফলে দিশাহারা হয়ে পড়ে ক্রেতারা। বিশেষ করে নিম্নআয়ের লোকজন। আর এ উত্তাপের আঁচ সাধারণ মানুষসহ সরকারের গা ছুঁয়ে যায়। মিডিয়া থেকে সবর্ত্র আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। গত বছর ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল, তার পরের প্রতিক্রিয়া তো সবার জানা। পেঁয়াজের দামে বিশ্বরেকর্ড হয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছিল, এমনকি ভিআইপি মর্যাদায় পেঁয়াজ এনেছিল বিমানে করেও।

সম্প্রতি ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করল এরপর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছিল পেঁয়াজের বাজার। কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার সেই ভারত অল্প কিছু পেঁয়াজ রপ্তানি করবে, এ খবরে দাম কিছুটা কমেও যেতে দেখা গেছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর রোববার হিলি ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আবারও পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। তবে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে।

ভারত পেঁয়াজ নিয়ে এ নাটক নতুন নয়। আসলে, যে কারণেই হোক না কেন আমরা পেঁয়াজে স্বনির্ভর হতে পারছি না। আর সে পরনির্ভরতার সুযোগ নিচ্ছে পাশের দেশ। অথচ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ কিন্তু আমাদের রয়েছে। এ জন্য পেঁয়াজ সংরক্ষণের দিকে মনোযোগী হতে হবে, যাতে সারা বছরই পেঁয়াজের সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায়। এ ছাড়া আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। মজুত ব্যবস্থা জোরদার করাসহ স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। পেঁয়াজ চাষিদের একটি নির্ভরযোগ্য স্থিতিশীল বাজারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমাদেরও একটু দাম দিয়ে পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে যাতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

সরকারি হিসাবে, দেশে প্রতি বছর ২৩ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। তবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর প্রায় ১৯ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ থাকে। অথচ চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের। বাকি ১১ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়, যার বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। প্রতিবেশী দেশ, সড়ক পথে দ্রম্নত আনা, কম দাম বিবেচনায় প্রধানত ভারত থেকেই বেশির ভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এ আমদানি পরিহার করে দেশে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব। এ জন্য দেশের চাহিদা পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।

এক সময় আমাদের চালের খুবই সংকট ছিল। ভারত, ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করতে হতো। এখন আমাদের সংকট নেই। ধারাবাহিকভাবে দেশে বেড়েছে চালের উৎপাদন। এ কারণে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে চাল উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গেল বছরের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। এটা দেশের চাল উৎপাদনের সামর্থ্যরই বহির্প্রকাশ। এমনকি চাল আমরা কয়েকবার রপ্তানিও করেছি।

গরু নিয়ে ভারত আমাদের সঙ্গে কত কাহিনি করেছিল। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে গরু রপ্তানি বন্ধ করে ভেবেছিল আমরা গরু খাওয়াই ছেড়ে দেব। এখন সরকারের বিশেষ উদ্যোগে দেশে পর্যাপ্ত গরু উৎপাদন হচ্ছে। সংকট থেকে যে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে, তার বড় উদাহরণ বাংলাদেশের গবাদিপশু খাত। পাঁচ বছর আগেও দেশের চাহিদার বড় অংশ মিটত প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করে। গরুর চাহিদা আমাদের খামারিরাই মিটিয়ে দিচ্ছে। গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।

দেশে একসময় ইলিশের অভাব ছিল। এখন সংকট নেই। পৃথিবীতে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে। বাংলাদেশ মোট ইলিশ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ আহরণ করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ সমাপ্ত অর্থবছরে সেই রেকর্ড ভেঙে এখন পর্যন্ত ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত ১১ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ। অন্যান্য মাছের চাহিদাও চাষের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। মাছ চাষেও আমরা চতুর্থ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- পেঁয়াজ কেন এখনো ভোগাচ্ছে! আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে?

আমার মতে চাল, গরু, মাছ সমস্যার সমাধান আমরা যেভাবে করেছি, সেভাবে পরিকল্পনা করলে শতভাগ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন সম্ভব। একজন কৃষিবিদ হিসেবে আমি যতটুকু জানি, সে সমস্যার সমাধান আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা বের করে দিয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তার ব্যবহার কম বলে এ পরিস্থিতি সম্মুখীন আমাদের হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পেঁয়াজের গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন যে জাতগুলো উদ্ভাবন করেছে, সেগুলো নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে ব্যাপকহারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।

পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল। শীতকালের চাষকৃত পেঁয়াজ দিয়েই আমাদের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। যেহেতু দরকার মাত্র ৩০ শতাংশ, তাই একটা নির্দিষ্ট জোন বা এলাকায় চাষ করলেই চলে। কোন কোন এলাকা চাষ করা হবে আর কীভাবে কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী করে তুলতে হবে, তার জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী যারা রয়েছে তাদের আরও বেশি জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের তিনটি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজে জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। যার স্বাদ এবং ফলন কোনোটাই শীতকালীন পেঁয়াজের চেয়ে কম নয়। এর মধ্যে বারি পেঁয়াজ-২ এবং ৩ বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে চাষ করার জন্য উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এ সব পেঁয়াজের বীজ ফেব্রম্নয়ারি থেকে মার্চ মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের ভেতর জমিতে বুনতে হয়। এসব বীজ গজানোর পর এপ্রিল মাসে মাঠে চারা রোপণ করা হয়। গ্রীষ্মকালীন চারা মাঠে লাগানোর ৮০ থেকে ৯০ দিনের ভেতর পেঁয়াজ সংগ্রহ করার উপযোগী হয়ে যায়। ফলে জুলাই-আগস্ট মাসের ভেতর সংগ্রহ করে ফেলা সম্ভব। যা শীতকালীন পেঁয়াজ সংগ্রহ করার চার মাস আগেই পাওয়া যায়। প্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বর্ষাকালেও চাষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে চারা উৎপাদন করতে হয়। উঁচু জমি হলে ভালো হয়। যাতে জমিতে পানি জমতে না পারে। জুলাই থেকে আগস্ট মাসে চারা করে সেপ্টেম্বর মাসেই চারা মূল জমিতে লাগানো যায়। এতে অন্তত দুই মাস আগেই পেঁয়াজ সংগ্রহ করা যায়। বর্ষাকালে লাগালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ জাতগুলো ৫০ থেকে ৫৫ দিন পরেই সংগ্রহ করা যায়। এর ফলে দেশে শতভাগ পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব।

দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী প্রধান এলাকা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, বগুড়া ও লালমনিরহাট। এ সব এলাকায় কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বেশি উৎসাহ দিতে হবে।

সর্বোপরি, সঠিক নিয়মানুযায়ী গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা গেলে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা শূন্য শতাংশে নেমে আসবে। সেই সঙ্গে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনেরও স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করব।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। আর পেঁয়াজের জাত উন্নয়নের গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো। তাহলে দেশি পেঁয়াজ দিয়েই আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।

বশিরুল ইসলাম : জনসংযোগ কর্মকর্তা. শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সনধংযরৎঢ়ৎড়১৯৮৬@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113111 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1