শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষণ

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যেদিন বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ঘটনা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্র্ণ। সেই ঐতিহাসিক বিশ্বজনীন দিন ও ক্ষণ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের সব জাতি-রাষ্ট্রের সম্মিলিত সংস্থা জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্বজনীন আবেদনের বহির্প্রকাশ ঘটান। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, 'যে মহান আদর্র্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন।' বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে মূলত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। প্রাথমিকভাবে ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই জাতীয়তাবাদের মহান নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে যে সময় বাংলায় ভাষণ প্রদান করেছিলেন তার অনেক আগেই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালি গীতিকার তখন যথার্থই ব্যক্ত করেছিলেন, '... এই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিল, কার সে কণ্ঠস্বর, মুজিবর সে যে মুজিবর...।' বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এক সময় যে আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনের রক্তের স্রোতধারা আরও অনেক আত্মত্যাগ ও রক্তধারার সঙ্গে মিলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানের রক্ত সাগরে মিলিত হয়ে বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্যোদয় সম্ভব করেছে। এভাবে ভাষার দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে জাতিরাষ্ট্র অভু্যদয়ের আন্দোলনকে গবেষকরা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভাষাভিত্তিক বিশেষ করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভু্যদয়ের সম্পর্ক অতি স্পষ্ট। বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্র ভাষার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বাঙালি জাতির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। বাঙালি কবি বলেছেন, 'শোনরে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।' হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জীবন-মরণ যুদ্ধে জয়লাভ করে বাঙালিদের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠার পর বাংলার বিশ্বজনীন আদর্শ বিশ্ববাসীর সামনে ঘোষণা দেওয়ার লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। বর্র্তমান এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কর্তৃক জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় দেওয়া ভাষণের প্রেক্ষাপট এবং ফলশ্রম্নতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য (পূর্ব) বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৫ মার্চ গভীর রাতের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের জনগণ সর্বতোভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সমর্র্থন যুগিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এডওয়ার্ড কেনেডি, ফ্রাঙ্ক চার্চ; যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারিয়ান পিটার শোর, জনন স্টোন হাউস, রেজিনাল প্রেনিটি, মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সংবাদপত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, সংবাদ সাময়িকী নিউজউইক, টাইম ম্যাগাজিন প্রভৃতির সাংবাদিক-প্রতিনিধিরা, সানডে টাইমস, লন্ডন টাইমস, গার্ডিয়ান, লা মনদে প্রভৃতির বার্তা প্রতিনিধি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে ভারতে চলে আসা শরণার্থীদের দুর্দশা এবং তৎকালীন পূর্র্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য ছুটে এসেছিলেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের আরোহণ কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল না। বস্তুতপক্ষে ১৯৭১ সালের মার্র্চের শেষ দিকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নেতারা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বর্বরতার দিকে নজর দেয়ার জন্য এই বিশ্ব সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছিলেন। ১৯৭১ সালের শরৎকালে জাতিসংঘ যখন সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের চেষ্টা করছিল তখন বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশের পক্ষে জাতিসংঘে কথা বলার জন্য প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুনি খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিকদের একটি প্রতিনিধি দলকে নিউইয়র্ক পাঠানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মোশতাক তখন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। নিউইয়র্কে গিয়ে স্বাধীনতার পরিবর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে বিষয়টির পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেলের সহায়তায় ষড়যন্ত্র করেছিল খোন্দকার মোশতাক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে মোশতাকের আর নিউইয়র্ক যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে মোশতাকের সেই ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর বাংলাদেশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য বলেন। ১৯৭১-এর শেষের দিকে বাংলাদেশ ইসু্যটি জাতিসংঘের একটি নিবিড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে যখন ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন থেকে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা একটার পর একটা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হচ্ছিল তখন যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আর এসময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধকে থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি জুলফিকার আলী ভুট্টো এ সময় কিছু নাটকীয় বক্তব্য রেখেছিলেন। সে সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধীন মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রী ছিলের বাঙালি নুরুল আমিন এবং ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন ভুট্টো সাহেব। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের খবরে রাগান্বিত ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদে বলেছিলেন পাকিস্তান প্রয়োজনে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। ভুট্টো কর্তৃক ঘোষিত হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধ করার পাকিস্তানি বাসনা এখনো পাকিস্তানের সরকার অব্যাহত রেখেছে বলে মনে হয়। তবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টা পাকিস্তানের কারণে স্বাধীনতার তিন বছর পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করলেও বিজয়ের তিন বছর অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের ভাবাবেগকে সমর্থন করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এশিয়া মহাদেশ থেকে একমাত্র স্থায়ী সদস্য চীন তখন সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আবেদনের প্রবল বিরোধিতা করছিল। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের এই চীনা বিরোধিতা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এমনকি চীন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ৩০ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাংলাদেশের চীনা দূতাবাস এখনো ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার কৃত্রিম ও প্রতিহিংসাপূর্ণ জন্মদিবসে শুভেচ্ছা জানায় এবং ভুল স্বীকার করে তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের জন্য শোক প্রকাশ করে না। রাজনীতি এক অদ্ভুত ব্যাপার। যা হোক, ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্র্ট ওয়াল্ডহেইম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলার জন্য বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছিল। এগুলো হচ্ছে কমনওয়েলথ, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রভৃতি। যা হোক, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ পস্নাজায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তমাখা পতাকা উত্তোলন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পরবর্র্তীকালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ এক মর্যাদাপূর্ণ সদস্য হিসেবে সম্মানিত হচ্ছে। অতএব ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যেদিন বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ঘটনা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্র্ণ। সেই ঐতিহাসিক বিশ্বজনীন দিন ও ক্ষণ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : 'ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থের লেখক, সাবেক-চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে