ঢিলেঢালা জীবনযাপন এবং করোনার তান্ডব

একথা সত্য, আমরা এক ভয়ংকর সময় অতিক্রম করছি। আমরা বলতে গোটা বিশ্ববাসীই। এ সময় সাহস, সচেতনতা, সতর্কতাই সবচেয়ে আগে দরকার। মানুষের মধ্যে মনোবল বাড়ানোর কাজ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

মীর আব্দুল আলীম
বাংলাদেশে করোনা আছে; ভয় পালিয়েছে। নমুনা পরীক্ষা কমলেও করোনাভাইরাসে মৃতু্য ও আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র এখনো ভয়াবহই বলতে হয়। শীত আসছে। ভয়াবহতা শীতে আরও বাড়বে। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমনটা বলেছেন। এখন আমরা যেভাবে চলছি, এমন ভয়হীন চলাচল আমাদের যে মৃতু্যর মুখোমুখি করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মহামারি হেলাফেলা সত্যিই আত্মঘাতী। মানুষের স্বাভাবিক চলা ফেরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে মাস্কবিহীন চলাফেরা ভাবনায় ফেলেছে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। ঢিলেঢালা জীবনযাত্রায় করোনাভাইরাস দেশে যে কোনো সময় তান্ডব চালাতে পারে। বিষয়টি ভাবনার বটে! ছয় মাসেও দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র আমাদের কাছে নেই। দেশে করোনাসংক্রমণ এবং মৃতু্যর সঠিক চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে না। নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে কম, মৃতু্যর হিসাবে উপসর্গ নিয়ে মৃতদের সংখ্যা নেই। সরকারি হিসেবে গত এক মাসে প্রায় সাড়ে ৯শ মানুষ করোনায় মারা গেছেন। আর এক মাসে করোনা রোগীশনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার। শনাক্তের হারে অন্য দেশের তুলনায় মৃতু্যর হার বাংলাদেশে বেশি। সেজন্য দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এটি বলতে নারাজ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষার অভাবে শনাক্ত ও মৃতু্যর হারের সঠিক সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে পুরানো পত্রিকা দৈনিক সংবাদ গত ১৮ সেপ্টেম্বর শীর্ষ সংবাদ হিসেবে ছেপেছে সংবাদটি। বলতে হয় বর্তমানে দেশে করোনার অবস্থা সমান্তরাল। প্রতিদিন মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রতিদিন বেশকিছু মানুষ মারা যাচ্ছেন। জনগণ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বেরিয়ে পড়েছেন, সতর্কতা নেই, ঢিলেঢালাভাব সর্বত্র। সব মিলে বাংলাদেশে এখন আর করোনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নেই। করোনাভাইরাস নিজের মতো চলছে যে কোনো সময় সংক্রমণ বেড়েও যেতে পারে। এখন করোনা হালছাড়া নৌকার মতো ভেসে চলছে। যখন করোনা পরীক্ষা করার জন্য মানুষ আগ্রহ ছিল তখন নমুনা পরীক্ষা ফি আরোপ করে নিরুৎসাহী করা হয়েছে। হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতে মানুষ আর করোনা নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ভালো চিকিৎসা পায়নি বলে করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন মানুষ আগের মতো হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। দেশে করোনার অবস্থা সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সারোয়ার আলী একটি বক্তব্য পত্রিকায় দেখলাম। তিনি বলেন, সরকারি হিসেবে দেশে করোনা সংক্রমণ কমেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের তুলনায় মৃতু্যর হার কম বাংলাদেশে। কিন্তু করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা মৃতু্যবরণ করছেন তাদের সংখ্যা সরকারের তালিকার মধ্যে নেই। সুতরাং করোনা মৃতু্যর সংখ্যা একটু বেশি হবে বলে আমার ধারণা। এছাড়া দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে এই কথা বলার সময় এখনো আসেনি। বিশ্বের কোনো দেশই এ মুহূর্তে বলতে পারবে না যে, তাদের দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ এখন নতুন করে লকডাউনে যাচ্ছে। আমাদের সরকারকেও এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। দেশে করোনা সংক্রমণের ছয় মাসের বেশি সময় পেরোলেও এখনো সব জেলায় নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র (ল্যাব) চালু করতে পারেনি সরকার। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৬টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু আছে। পরীক্ষাকেন্দ্র না থাকা ৩৮ জেলায় রোগী শনাক্তের পরিমাণ কম। নমুনা পরীক্ষা এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। ফলে জনসংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষার দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সরকারের করোনাবিষয়ক পুরো কার্যক্রমেই একটা গাছাড়া, ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও জেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করেনি। পরীক্ষা কম হওয়ায় সন্দেহভাজন অনেক রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি যে ভালো নয় এখানে একদিনের একটি চিত্র তুলে ধরলে নিশ্চয় বিষয়টিতে পরিস্কার ধারণা পাবেন পাঠক। ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার দেশে দেড় মাসে সর্বনিম্ন একদিনে ২১ জনের মৃতু্য হয়েছে আর ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার চব্বিশ ঘণ্টায় ৩৬ জনের মৃতু্য হয়েছে। বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার ১৫ জন মানুষের মৃতু্য বেশি হয়েছে। এ দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে আরও এক হাজার ৫৯৩ জন। সব মিলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃতু্য হয়েছে ৪ হাজার ৮৫৯ জনের। আর মোট করোনা রোগীশনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৬৪ জন। আগের তুলনায় করোনার নমুনা পরীক্ষা কমানোর ফলে শনাক্তের হার কমছে কিন্তু মৃতু্যর হার বাড়ছে। এ থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনা নমুনা পরীক্ষা বাড়লে শনাক্ত বেশি হবে। সেই ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যাও বাড়তে পারে। সেখানে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসন্ন শীতকালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে উলেস্নখ করে এ মুহূর্ত থেকেই তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'শীতকাল আসন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। আমাদের এই মুহূর্ত থেকেই তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। 'আসলে আমরা সতর্ক নই বললেই চলে। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। হাটবাজার পুরোদমে জমছে। কখনো কখনো মনে হয় আগের চেয়ে বাজারে এখন যেন \হবেশি মানুষ। মানুষের হুঁশ নেই। মজুতদাররা এই সুযোগে পেঁয়াজ, চাল, ডাল, তেল, ঝাল মরিচের দাম বেড়েই চলেছে। হুজুগে বাঙালতো বলেছিল; নাকি দুর্ভিক্ষ লেগে যাবে দেশে। সরকার বেশ কৈশলী ছিল তাই যতটা অর্থনীতিতে আঘাত পড়ার কথা ততটা হয়নি। লকডাউন খুলে দেয়া নিয়ে আমরা সমালোচনা করলেও আমাদের মতো দরিদ্র দেশের প্রেক্ষাপটে সরকারের যে অনেক ভুল করেছে তা বলা যাবে না। অন্য ধনী দেশের মতো করে লকডাউনে থাকলে দেশ অচল হয়ে যেত। তাতে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ত। তা ছাড়া মানুষতো লকডাউন মানছিলই না। তাই অর্থনীতি অচল করতে সরকার কিছুটা শিথিল ছিল। অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে দেশের মানুষ। তবে এতটা স্বাভাবি জীবনযাত্রা ভয়বহতাই ডেকে আনতে পারে। আমরা নিয়মনীতির কোনোই তোয়াক্কা করছি না। যে যার মতো করে চলছি। সামাজিক দূরত্ব একেবারেই মানছি না। মাস্ক পরছি না। এমন অসাবধানতা আমাদের ভাগ্যে যে দুর্গতি ডেকে আনতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা বিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারব কতটা ক্ষতি হলো আমাদের। আলস্নাহ মাফ করুক। একটা কথা মনে রাখতে হবে সার্স, ডেঙ্গু বা ইবোলার মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এমন মহাবিপদ থেকে আলস্নাহ আমাদের উদ্ধারও করেন। ইসলাম ধর্মে এসব রোগবালাইয়ের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আল-কোরআনে মহামারি হলে যে যার স্থানে থাকার কথা বলা আছে। অন্য ধর্মেও রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক করা আছে। প্রয়োজন না হলে ক'দিন নিজের জন্য; পরিবারের জন্য; অন্যের জন্য ঘর থেকে বাহিরে না যাওয়াই ভালো। প্রয়োজন থাকলে কি আর করা। আলস্নাহ ভরসা। মনে রাখবেন এ সমস্যা কিন্তু অনেক দিন ধরে থাকবে না। আলস্নাহ আমাদের রক্ষা করবেনই। কিছুদিন যারা সতর্ক থাকতে পারবেন, সব কিছু ঠিকঠাক মেনে চলবেন তারা হয়তো এ বিপদ থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকতে পারবেন। তবে আমারা বেশিই অসাবধান মনে হয়। কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দিতে চাই না কখনো। কোনো কিছু মানতে চাই না। হয়তো আলস্নাহই আমাদের রক্ষা করবেন। যে যাই বলিনা কেন, করোনাভাইরাসের যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। অহেতুক ঘুরতে না যাওয়ার, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়ার, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। সবাই সতর্কতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আমরা হয়তো এ যুদ্ধে হেরে যাব। আসুন সবাই সতর্কতার যুদ্ধে নামি। যেহেতু করোনার ভেকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি সেজন্য সতর্কতার যুদ্ধের বিকল্প নেই। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশাহারা হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। নিজে সতর্ক থাকতে হবে অপরকে সতর্ক করতে হবে। ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ সতর্কতা। এখনো বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। করোনায় আমাদের জীবনের ঝুঁকি কেবল তা নয় অর্থনৈতিকভাবেও আমরা পিছিয়ে যাব। এ দিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড করোনাভাইরাসের কারণে বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এটা ভাববারই বিষয়। তবে আমরা শুরুতে যতটা আক্রান্ত এবং মৃতু্যর সংখ্যা নিয়ে ভাবছিলাম সে পর্যায়ে এখনও যায়নি বাংলাদেশ। আমরা যোদ্ধার দেশ। আমাদের যুদ্ধ করেই সব সময় বাঁচতে হয়। বন্যা, ঝড়, অতি ক্ষরাসহ নানা প্রতিকুলতার মধ্যেই আমাদের বাঁচতে হয়। আলস্নাহ আমাদের সহায় হন সব সময়। সব যুদ্ধকে জয় করতে হয় আমাদের। আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশ পেয়েছি। ডেঙ্গু, কলেরা-ডায়েরিয়া মহামারি সামনে ফেলে সফল হয়েছি। করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে আমাদের এ পরিস্থিতিও জয় করতেই হবে। সব ভয়কেই দূরে সরিয়ে নির্ভয়ের, নিরাপদে বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের। \হএকথা সত্য, আমরা এক ভয়ংকর সময় অতিক্রম করছি। আমরা বলতে গোটা বিশ্ববাসীই। এ সময় সাহস, সচেতনতা, সতর্কতাই সবচেয়ে আগে দরকার। মানুষের মধ্যে মনোবল বাড়ানোর কাজ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। নিজে সচেতন হতে হবে, পরিবার, প্রতিবেশীদের সচেতন করতে হবে। সাহস দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিনিয়ত জনগণকে সাহস জোগাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, প্যানিক (আতঙ্ক) করবেন না, শক্ত থাকেন, সচেতন হোন। প্রকৃতই সচেতন না হওয়ার বিকল্প নেই। ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে মিলেমিশে সতর্কতার সঙ্গে এ বিপদকালীন সময় পার করতে হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগ লুকিয়ে রাখার মতো বোকামি করা চলবে না। পরিবার তথা সমাজের অন্যকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এই সচেতনতাটুকু সবার মধ্যে থাকা চাই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। অন্যকে সহযোগিতা করা ও সচেতন করে তোলার দ্বায়িত্ব আমাদের সবার। এ ব্যাপারে প্রশাসন ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। এব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক ও কলামিস্ট