১৭ মে, ১৯৮১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে বাংলার মাটিতে পদার্পণ করেন জাতির পিতা কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেই নির্মম হত্যাকান্ড সংঘঠিত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। সেই কারণেই তাদের জীবন বেঁচে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে দুটি প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্ববহ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও স্বাধীনতার মহান স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শত্রম্নপক্ষ অর্থাৎ পাকিস্তানের কারাগারে তখনও আটক ছিলেন। বাংলার মানুষ দুশ্চিন্তায় ছিলেন কখন ফিরে আসবেন স্বাধীন সার্বভৌম দেশে তার প্রিয় নেতা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বাদ তখনও পায়নি। জনগণ মুক্তিযুদ্ধ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে বলে মনে করছিল। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ এক চরম হতাশায় বিরাজ করছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সেই উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের অবসান ঘটে। স্বাধীনতার পূর্ণতা লাভ করে। জনগণ তাদের অবিসংবাদিত নেতাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। আর ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার আগে সেদিনের বাস্তবতাটাই বা কি ছিল? পিতার স্বাধীন করা বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছিল একজন স্বৈরশাসক দ্বারা। যার অবস্থান ছিল সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যার আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একে একে বিসর্জিত হলো। জাতি রাষ্ট্রকে যিনি পুনরায় ধর্মরাষ্ট্র করার উদ্যোগ নেন। জাতির পিতার নাম নেওয়া যার আমলে নিষিদ্ধ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের স্স্নোগান জয় বাংলা ছিল পরিতায্য। মুক্তিযুদ্ধের শত্রম্নদের সঙ্গে নিয়ে সরকার পরিচালনা করেছেন একজন স্বৈরশাসক। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংঘঠিত হওয়ার কারণে যিনি বাংলাদেশে হর্তাকর্তা বনে গেলেন এবং ওই হত্যাকান্ড যার চক্রান্তে সংঘঠিত হয়েছিল এবং ক্ষমতার লোভে যিনি হত্যাকান্ড সংঘঠিত করেছিলেন ঠিক এমনই এক সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলীয় সভানেত্রী নির্বাচিত করেন। কীভাবে সে কাউন্সিল হয়েছিল, কেন সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৃতীয় দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, কারা সেদিন শেখ হাসিনার নির্বাচিত হওয়ার পক্ষে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, সেসব কথা বিবেচনায় না নিয়ে একটা কথা নির্বিঘ্ন্নে বলা যায় যে ৯৮ ভাগ কাউন্সিলর স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে শেখ হাসিনাকে দলীয় প্রধান হিসেবে বরণ করেন। উচ্চ জাতীয়পর্যায়ে নেতাদের ভিতর শেখ হাসিনাকে দলীয় প্রধান না করার যে চিন্তা-ধারা কার্যকর ছিল, তারই প্রতিফলন দেখা যায় পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর বাকশাল গঠন ও আরও কিছুদিন পর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠন করা হয়। সেদিন সামরিক শাসক জিয়াই শুধু শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের পথে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করেননি। অনেকেই ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের ওই নেতাদের ধারণা ছিল শেখ হাসিনা ফিরে এলে তিনি বঙ্গবন্ধুর ধারক এবং বাহক হবেন এবং জনগণ তাকেই অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবেন। তখন তাদের নেতৃত্ব অকার্যকর হয়ে পড়বে। আসলেই এ কারণেই তারা এমনকি অস্ত্রের মাধ্যমে হলেও সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিলেন। এসব কথা এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। আমরা নবাব সিরাজুদৌলার আমলে ইংরেজ সৃষ্ট কল্পিত অন্ধকূপ হত্যার কথা জানি। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও এমন কিছু ঘটনাপ্রবাহ মানুষের অজান্তে রয়ে গেছে; যা হয়তো কোনো দিন কেউ জানতে পারবে না। মিথ্যা এখনো সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত আছে এবং সেই মিথ্যার ওপর ভর করেই এখনো অনেক নেতারা তাদের রাজনৈতিক চাকচিক্য ও জলুস অব্যাহত রেখেছেন। তবে সত্য যে, মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে এবং তারা আতঙ্কিত হচ্ছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এদেশের জনগণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কখনো ভুল করেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক যদি ভুল করতেন, তাহলে এদেশ কোনো দিনই স্বাধীন হতো না। ১৯৮১ সালে সেদিনের বাস্তবতায় জনগণ স্পষ্টভাবে অনুধাবন করেছিল, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে একমাত্র তারই কন্যা শেখ হাসিনা পারেন বঙ্গবন্ধুর শূন্য স্থান পূরণ করতে। সেদিনের সেই মহাসংকট কাল যখন একটা জাতি ৩০ লাখ শহিদের বিনিময়ে স্বাধীন করা একটা দেশে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বিসর্জিত হয়ে ধ্বংসের দিকে দ্রম্নত ধাবিত হচ্ছে, সংবিধানের মূল নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে, যে জাতীয়তাবাদীর ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হলো, তা পরিবর্তিত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ জাতি রাষ্ট্রকে ধর্মসাপেক্ষে সাম্প্র্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তর করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মহান স্স্নোগান পরিবর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতার নাম নিষিদ্ধ হয়েছে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যে রাষ্ট্রের জন্ম নিল সেখানে মাত্র ১০% লোককে সব সম্পদের মালিকানা করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে সামাজিক মূল শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে চলেছে চরম স্বৈরাচার। এক ব্যক্তির মুখের কথায় দেশের আইন। স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে দেশকে পুনরায় পাকিস্তানিপন্থি করে তুলেছেন। ঠিক এমন একটি সময় বাংলাদেশের মাটিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনার পদার্পণ। তারপর সেদিন শেখ হাসিনাকে দলীয় প্রধান হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল। দেশে ফিরে প্রায় ১৫ বছর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিকভাবে তিনি সরকারপ্রধান হন। ৫ বছর দেশ শাসন করেন। ২০০৮ সালে আবার তিনি ক্ষমতাসীন হন। টানা ১২ বছর তিনি দেশ পরিচালনা করছেন। তার এই প্রায় ১৭ বছর শাসনকালে তিনি দেশ এবং জাতিকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছেন তার হিসাব নিলেই অনুধাবন করা সম্ভব কেন সেদিন শেখ হাসিনাকে বাংলার জনগণ নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এটা কোনো গল্পকাহিনী নয়। সেদিন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা কী ছিল? সেদিন বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে চরম বিপর্যয় ছিল, তা থেকে জাতিকে মহাসংকট থেকে উত্তোরণ করেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের এই মহান নেত্রী আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আজ একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অবদান রাখার জন্য তিনি এ পর্যন্ত ৪০টি আন্তর্জাতিক পদকে ভূষিত হয়েছেন। এটা দেশের জন্য বড় সম্মানের ও গৌরবের বিষয়। তার যোগ্য নেতৃত্বে দেশের মানুষের গড় আয়, পাঁচশত ডলার থেকে দুই হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। যেখানে বিদু্যতের উৎপাদন ছিল দুই হাজার মেগাওয়াট তা তিনি বৃদ্ধি করে চব্বিশ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছেন। খাদ্য ঘাটতি দেশ এখন খাদ্যের স্বনির্ভর ও রপ্তানির ক্ষমতা অর্জন করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৮.২% এ উন্নীত হয়েছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে যে দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। জনগণ এর সুফল ভোগ করবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। মহাকাশে আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করতে সফল হয়েছি। সমেিদ্র সাবমেরিন প্রতিষ্ঠা করে আমাদের জলসীমা রক্ষার নিশ্চিয়তা এসেছে। বছরের প্রথমদিকেই বিনামীল্যে ৩৫ কোটি বই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। দুঃখী মানুষের জন্য সর্বাত্মকভাবে অনুদান-প্রদান করা হচ্ছে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে সমাধিত। মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য। তিনি মানবতার মা হিসেবে ভূষিত হয়েছেন।
দীর্ঘ সময় দেশ শাসনকালে তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। জনগণের বিপদে-আপদে তিনি সবসময় পাশে থাকেন। তিনি দুঃখী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। তিনি সবসময় বলে থাকেন আমি জনগণের শাসক নই, সেবক। এবার করোনাকালেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এবারও প্রমাণ করলেন তিনি দরিদ্রবান্ধব।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের দারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই গতিধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই পর্যায়ে বাংলাদেশকে পৌঁছানের মূলে নেতৃত্বে রয়েছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী, বাংলার দুঃখী মানুষের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত যোগ্য নেতৃত্ব। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, ধন-বৈষম্য দূর করা এবং শোষণ বঞ্চনাহীন একটি আধুনিক, কল্যাণমুখী, গণতান্ত্রিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক রাষ্ট্রে নির্মাণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এই উন্নয়নের মহাযজ্ঞ বাস্তবায়নে তিনি শুধু পরিকল্পনাই নয়, মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছেন এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করছেন। রাজনীতিতে সফলতা-ব্যর্থতা সব কিছুই থাকে। উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিচার করলে শেখ হাসিনা অবশ্যই একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক এটা শুধু বাংলাদেশ নয়- বিশ্ববাসীও আজ স্বীকৃতি দিয়েছে।
ডা. এস এ মালেক: বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট এবং রাজনীতিক