ভাষার মাসে শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বাংলা ভাষা

বিশ্বে রক্ত ঝরিয়ে ভাষার অধিকার আদায় করেছে একমাত্র বাঙালি জাতি। যার ফলস্বরূপ, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা প্রদান করতে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ একে-অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার যে প্রয়াস ভাষা শহীদেরা দিয়ে গেছেন তা আমরা কতটুকু ধারণ করতে পারছি? এই বিষয় নিয়েই 'বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বাংলা ভাষার প্রতি কীরূপ প্রতিক্রিয়া বিরাজমান' তা তুলে ধরেছেন -ইকরাম আকাশ

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

ইকরাম আকাশ
ভাষার মাসে বাংলা ভাষার আত্মোপলব্ধি আমরা বাঙালি আমরা বাংলায় কথা বলি। আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। ভাষার মাসে আমরা শ্রদ্ধাভরে শহীদদের স্মরণ করি। আমরা স্বাধীনভাবে বাংলায় কথা বলতে পারি কিন্তু বাংলার সঠিক উচ্চারণ ও প্রয়োগ করতে পারি না। আমরা বাংলা শেখার প্রতি মনোযোগী নই, তাই বাংলা ভাষা তার সঠিক মর্মার্থ হারিয়ে ফেলছে। দেশে এখন নিজের মাতৃভাষার চেয়ে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রায় সবাই আজ এতটাই দক্ষ হচ্ছে যে, তারা তাদের মূল মাতৃভাষার আবেদন হারিয়ে ফেলছে। বাঙালি শব্দটার সঙ্গে বাংলা ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাষার মাসে আমরা বাংলাকে উপলব্ধি করা শিখব এবং আমাদের সন্তানদের আন্তর্জাতিক ভাষা শিখানোর আগে তাদের বাংলা ভাষা শিখাব। বাঙালি হয়েও বাংলার প্রতি আমাদের যে অবহেলা তা দূর করতে হবে। ফাহমিদা জামান শিক্ষার্থী, সরকারি মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম। বিশ্বমঞ্চে বাংলা ভাষার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা বায়ান্নর বিপস্নবী ছাত্র জনতার জন্যই আমরা 'বাংলাভাষা'কে মাতৃভাষা হিসেবে অর্জন করতে পেরেছি। বিশ্বমঞ্চে বাংলাভাষার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা' দিবস। রঞ্জিত রক্তের বহমান রাস্তায় শহীদদের বলিদান বৃথা যায়নি। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের উদাসীনতা বেশি। সবার মন-মগজে পাশ্চাত্যের ভাষা অবস্থান নিয়ে রেখেছে- যা বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননার শামিল। বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষাকে অগ্রাহ্যতার চোখে দেখা হয়; শুদ্ধাচার ব্যবহার নেই বললেই চলে। বাংলিশ ব্যবহারে সবাই এত পারদর্শী আগামী কিছু বছর পর হয়ত বাংলাভাষার নিজস্ব গতিধারার পথ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। দ্রম্নত নিজেদের সংশোধন ও বাংলাভাষার প্রতি নিজেদের সুস্পষ্ট অবস্থান তৈরি করতে না পারলে, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার বিকৃতরূপ দেখে মনঃক্ষুণ্ন্ন হতে হবে। তাই আমাদের সবার উচিত স্ব-অবস্থান থেকে শুধু ফেব্রম্নয়ারি নয় প্রতি মাসকেই ভাষার মাস হিসেবে পালন করি এবং বাংলা ভাষার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবার মাঝে প্রসার ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাই। আসমা আকতার শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ। ভিনদেশি ভাষার ছত্রছায়ায় স্বদেশি ভাষার মায়া ম্স্নান হচ্ছে সময়ের পরিক্রমায় যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে আমরা নানা ভিনদেশি ভাষা রপ্ত করছি। এমনকি একটি ভিন্ন দেশে আরোহণ করতে গিয়েও সে দেশের ভাষা রপ্ত করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অবশ্যই অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই; কিন্তু যে দেশে আমাদের শেকড় সেই দেশের ভাষা আমরা কতটুকু শুদ্ধভাবে শেখার আগ্রহ রাখি? ভিনদেশি ভাষায় আকৃষ্ট হয়ে যশ-খ্যাতির মোহে পড়ে পুনরায় ভুল বুঝতে পেরে মাতৃভাষায় মনোনিবেশ করা বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা কে না জানে। তিনি ভুল বুঝতে পেরে নাড়ির টানে ফিরতে পারলেও আমাদের কি ফেরার সময় হয়েছে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও আমরা সেই ভাষার মর্মবাণীই নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারিনি। তবে, আশার কথা হলো, অনেক সাহিত্য অনুরাগী ব্যক্তিবর্গ বাংলা ভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা ভাষার হাতেখড়ি দিচ্ছেন। তৈয়বা খানম শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ। শুদ্ধভাবে বাংলা বলা ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, পরিচয় ও আত্মঅভিব্যক্তির প্রতিচ্ছবি। ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারি আমাদের মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতিজ্ঞা নেয়। তরুণ সমাজের কাছে ভাষা কেবল বইয়ের পাতায় বন্দি নয়, বরং এটি তাদের চিন্তা, সৃজনশীলতা ও স্বকীয়তার প্রকাশ। প্রযুক্তির প্রসার ও বিশ্বায়নের যুগে অনেকেই নিজের ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে- যা আমাদের ঐতিহ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই তরুণদের ভাষার প্রতি আরও সচেতন হতে হবে, শুদ্ধভাবে বাংলা বলা ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ভাষা শুধু অতীতের গৌরব নয়, এটি ভবিষ্যতের পথচলার শক্তি। ভাষার আত্মোপলব্ধি জাগিয়ে তুললেই প্রকৃত অর্থে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। মিজানুর রহমান শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম। রক্তে রঞ্জিত অর্জন ছিল বাংলা ভাষা অক্সিজেনবিহীন মানুষের বেঁচে থাকা যেমন দায়, ঠিক তেমনি মানুষের জীবনযাত্রায় ভাষাবিহীন অগ্রযাত্রা কঠিন। প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষের জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের ছোঁয়ায় ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য। যদি ভাষা না থাকতো তবে দৈনন্দিন কার্যক্রমের বিবিধ কার্যাদি আদিমকালের ন্যায় ছবি এঁকে, ইশারায় প্রকাশ করতে হতো। মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে- তবে স্বাচ্ছন্দ্যের ভাষা হলো নিজস্ব মাতৃভাষা। মাতৃভাষার অবাধ ব্যবহার নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক-বাহক। বাংলাভাষা এমন একটি ভাষা যার অর্জন ছিল রক্তে রঞ্জিত- যা অবিস্মরণীয়। স্বীকৃতস্বরূপ পুরোবিশ্বে একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ' হিসেবে শ্রদ্ধার সহিত পালন করা হয়। যা আমাদের বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের কাছে বাংলাভাষা যেন ম্স্নান হয়ে গিয়েছে; অন্য ভাষার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা ও অনধিক চর্চা বেড়েছে। মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ কমে গেলে এর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। তাই আমাদের উচিত নিজেদের সঙ্গে অন্যদের ও সঠিকভাবে, সুন্দর ও মার্জিতভাবে বাংলাভাষার চর্চা এবং সঠিক ব্যবহার করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা। নুসরাত অনন্যা শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ। ভাষা মানুষের কণ্ঠস্বরের মতোই ফেব্রম্নয়ারি মাস ভাষার মাস। এ মাস এলেই একটি স্স্নোগান সব সময় মনে পড়ে- 'মোদের গর্ব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।' পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। ভাষা মানুষের কণ্ঠস্বরের মতোই। মনের ভাব প্রকাশ করতে হলে কণ্ঠস্বরের যেমন প্রয়োজন তেমনি নিজেকে প্রকাশ করতে হলে নিজস্ব ভাষার প্রয়োজন। বাঙালির মহান আত্মত্যাগকে গোটা বিশ্ব স্মরণ করে ২১ ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে। পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশেরও একটি নির্দিষ্ট মাতৃভাষা আছে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা 'বাংলা'কে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি পেতে অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বীর বাঙালির জীবনের বিনিময়ে বাংলাকে এ দেশের মাতৃভাষা হিসেবে তৎকালীন সরকার স্বীকৃতি দেয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, বিশেষ করে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। লেখায়, বলায়, পঠনে-পাঠনে বাংলাকে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সম্মোহিত মর্যাদার আসনে। উম্মে সালমা শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ।