জামেয়ার প্রাঙ্গণে আজ যেন এক নতুন সূর্যোদয়! ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই ছাত্রদের চোখেমুখে খেলা করছে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। আজকের দিনটি যে কেবল আরেকটি দিন নয়, বরং এটি ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়! মাস্টার্স (সেশন ২২-২৩) শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত প্রথম সবক অনুষ্ঠান। আল কোরআন ও আল হাদিস ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সমন্বয়ে আজ চতুর্থ একাডেমিক ভবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। জ্ঞানের দীপশিখা জ্বলে উঠছে এক নতুন দিগন্তে, যেখানে জ্ঞান, সাধনা ও নূরের এক অভূতপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে।
নতুন একাডেমিক ভবন যেন সেজেছে এক অনন্য মর্যাদায়। এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি দেয়াল আজ সাক্ষী; এক স্বপ্নের বাস্তবায়নের। ছাত্রদের মনে আজ আনন্দের ঢেউ, যেন তারা এক নতুন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। এ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন পীর-এ-বাঙাল সায়ি্যদ সাবির শাহ মা. জি. আ ও শাহজাদা সায়ি্যদ কাসিম শাহ মা. জি. আ। আজ তাদের দোয়া, ভালোবাসা ও নেকনজরে ভবনটি হয়ে উঠছে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা।
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় মুহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায়। তেলাওয়াত করেন মাস্টার্সের ছাত্র হাফেজ আবদুলস্নাহ আল মাসুদ। তার সুললিত কণ্ঠে কোরআনের আয়াত যেন বয়ে আনলো প্রশান্তির বৃষ্টি। এরপর সবকে আউলার সুর ছড়িয়ে দেন হাফেজ সায়মন, আর মাস্টার্সের মেধাবী ছাত্র মাসুম বিলস্নাহ পরিবেশন করেন হৃদয়ছোঁয়া নাতে রাসুল (সা.)। পুরো জামেয়া যেন মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল এক পবিত্র সুরের মায়াজালে।
এরপর একে একে জামেয়ার প্রখ্যাত উস্তাদরা ছাত্রদের উদ্দেশে নসিহতপূর্ণ বক্তব্য দিতে থাকেন। তাদের কণ্ঠে যেন ফুটে ওঠে এক নতুন পথের দিশা। আলোচনার প্রতিটি শব্দে জ্ঞান, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির বাণী প্রতিধ্বনিত হয়। উপস্থিত ছিলেন আলস্নামা ড. কামালউদ্দিন আজহারি, আলস্নামা ড. বখতিয়ার উদ্দিন, আলস্নামা মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ ওমায়ের রজভী, আলস্নামা ইয়াকুব হোসাইন কাদেরি, আলস্নামা আবুল হাসনাত কাদেরিসহ আরও অনেক সম্মানিত উলামায়ে কেরাম।
অনার্স বিভাগের উস্তাদগণের উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে। মাওলানা মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন, মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল কাদের শওকী, মাওলানা মোহাম্মদ ইমরান হোসাইন, মাওলানা আবদে মোস্তফা মুহাম্মদ নুরুল আনোয়ার, মাওলানা মোহাম্মদ শফিউল বশর নঈমী, মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল কাদের জাওয়াদ, মাওলানা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, মাওলানা মোহাম্মদ মারুফ হোসাইন, মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল আনোয়ার- প্রতিটি উস্তাদ ছিলেন একেকটি জ্ঞানের মশাল, যাদের আলোতে ছাত্রদের হৃদয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
তবে এই আনন্দঘন মুহূর্তেও সবাই অনুভব করছিলেন এক শূন্যতা- একজন প্রিয় ওস্তাদের অনুপস্থিতি। মাওলানা মোহাম্মদ শওকত হুসাইন হুজুর, যিনি তার অসাধারণ শিক্ষা ও হৃদয়ছোঁয়া ব্যক্তিত্ব দিয়ে ছাত্রদের হৃদয়ে গভীর স্থান করে নিয়েছেন, আজ এখানে নেই। তার অন্যত্র পোস্টিং হওয়ায় তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও, মনে প্রাণে তিনি ছিলেন ছাত্রদের মাঝে। প্রতিটি কথায়, প্রতিটি স্মৃতিতে, তার শেখানো প্রতিটি পাঠে যেন তিনি আজও জীবন্ত হয়ে ছিলেন। যদি তিনি আজ এখানে থাকতেন, তবে এই আয়োজনের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যেত। সব ছাত্রদের মনেই আজ একটাই কথা- হুজুর, আমরা আপনাকে মিস করছি।'
স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন অনার্স বিভাগের চেয়ারম্যান আলস্নামা সাইফুদ্দিন খালেদ আজহারি হুজুর। ছাত্রদের উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে, যখন জামেয়ার গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবুল মহসিন মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য রাখেন।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পুরো মিলনায়তন নিস্তব্ধ, মনোযোগে ঠাসা। জামেয়ার অধ্যক্ষ আলস্নামা হাফেজ কাজী আব্দুল আলীম রেজভী মা. জি. আ সহিহ্ বুখারির প্রথম সবক প্রদান করেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন এক নবযাত্রার সুর হয়ে ধ্বনিত হয়। ছাত্ররা গভীর মনোযোগে শুনছিলেন, যেন তারা এক জ্ঞানের মহাসমুদ্রে প্রবেশ করছে। এই মুহূর্তটি যেন এক অলৌকিক দৃশ্য, যেখানে ছাত্রদের হৃদয়ে এক নতুন আলো জ্বলে উঠেছে- যা তাদের জীবনব্যাপী পথ দেখাবে।
এরপর দরুদ-কিয়ামের মাধ্যমে নবীজি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার স্রোত বয়ে যায় মিলনায়তনে। সমবেত কণ্ঠে সালাম প্রেরণ করা হয় মাশায়েখগণের উদ্দেশে। মোনাজাতে দু'হাত তুলে সবাই আলস্নাহর দরবারে বিনম্র প্রার্থনায় মগ্ন হন। নতুন ভবনের নবীন পথচলা যেন রহমত, বরকত আর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়- এই আশায় প্রতিটি হৃদয় একাকার হয়ে যায়।
মোনাজাত শেষে তাবারকের আয়োজন করা হয়। সবাই একসঙ্গে তাবারক গ্রহণ করেন। এরপর নতুন ভবনের সামনে ছাত্র-শিক্ষক মিলিত হয়ে ফটোসেশনে অংশ নেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখ, চোখেমুখে প্রশান্তি- এই ছবি একদিন স্মৃতির পাতায় ইতিহাস হয়ে থাকবে।
এই দিনটি শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য ছিল না; এটি ছিল এক নতুন ইতিহাসের সূচনা। একটি ভবন নয়, এটি এক শিক্ষার বাতিঘর, এক জ্ঞানের মিনার। এখান থেকেই একদিন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়বে দিগন্তজুড়ে। জামেয়ার এই নতুন ভোর একদিন পুরো বিশ্বকে আলোকিত করবে- এই স্বপ্ন, এই আশা, এই প্রার্থনা নিয়ে শেষ হলো এক অনন্য আয়োজন।