শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে সরকারি গণগ্রন্থাগার

খাদিজা আক্তার রিয়া
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে সরকারি গণগ্রন্থাগার
জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে সরকারি গণগ্রন্থাগার

ভবনের একটি পাঠকক্ষের ভেতরে চলছে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ পাঠকের জ্ঞান অন্বেষণের প্রক্রিয়া। আর পাঠকক্ষের প্রবেশপথের পাশেই খাতায় মুখ গুঁজে নিজের কাজ করছেন দায়িত্বে নিয়োজিত গণগ্রন্থাগারকর্মী। একটু সামনে বড় বড় পড়ার টেবিলে বই ও পত্রপত্রিকা। সেখানে কেউ কেউ প্রয়োজনীয় নোট নিচ্ছেন, কেউবা চোখ বুলাচ্ছেন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং জ্ঞানপিপাসু সাধারণ পাঠক নিজ নিজ কাজে মগ্ন। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ছুটির দিন ব্যতিত এ চিত্র প্রতিদিনের বললেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি গণগ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষ মোবাইলনির্ভর। অনলাইনে পাঠের সুবিধা থাকায় মানুষ কিছুটা বইবিমুখ হয়ে পড়ছেন, এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। লাইব্রেরিতে গিয়ে কিংবা বাসায় বই এনে পাঠে মনোনিবেশ, তরুণ প্রজন্মের কাছে এ যেন রূপকথার গল্পের মতো! যান্ত্রিক জীবনে সময় বাঁচাতে গিয়ে মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছেন সত্য, তবে প্রকৃত পাঠকও রয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণগ্রন্থাগারের প্রতিদিনের এমন চিত্রই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এমন দৃশ্য আশা জাগানিয়াও বটে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত তিতাস নদী অববাহিকায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপম ক্ষেত্র এবং ঐতিহ্যগতভাবে সমৃদ্ধ প্রাচীন জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। অতীতে এ অঞ্চল প্রাচীন বাংলার সমতটের অংশ ছিল। বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁ এই জেলার সরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। সরাইল পরগনার জমিদারি লাভের পর তিনি এই অঞ্চলে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। ইতিহাস মতে, ১৭৮১ সালে ইংরেজরা সরাইল পরগনা ব্যতীত বৃহত্তর কুমিলস্না ও নোয়াখালী নিয়ে একটি জেলা গঠন করে। জেলার নাম দেওয়া হয় টিপারা বা ত্রিপুরা জেলা। সাধারণভাবে ত্রিপুরা জেলা বলতে সমগ্র জেলা আর টিপারা প্রপার বলতে চাকলা রৌশনাবাদকে বোঝাত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন রৌশনাবাদের আওতাধীন ছিল। ১৮৬০ সালে ত্রিপুরার তিনটি মহকুমা থেকে নাসিরনগর মহকুমা সৃষ্টি হয়। ১৮৬৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭১ সালে মহকুমা সদর নাসিরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের প্রায় সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে সারাদেশে ৭০টি সরকারি গণগ্রন্থাগার গড়ে তোলার আওতায় জেলা শহরের কুমার শীলের মোড়ে সরকারি এ গণগ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অন্বেষণে তথ্য সংগ্রহের জন্য ১১ জানুয়ারি সকালে গণগ্রন্থাগারে গেলে জ্ঞান অন্বেষণের সমবেত এই দৃশ্য চোখে পড়ল। এটি ছাড়াও শহরের অবকাশ এলাকায় আরেকটি বেসরকারি পাবলিক লাইব্রেরি রয়েছে। এছাড়া, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি পাঠাগার। বলাই বাহুল্য, 'সমাজ থেকে নিরক্ষরতা ও চিন্তার পশ্চাৎপদতা দূরীকরণ, অর্জিত শিক্ষার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি, সামাজিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি, মূল্যবোধের বিকাশ, সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে তথ্য পরিবেশন প্রভৃতি কাজে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম ও অনন্যসাধারণ।' আর এই প্রত্যয় নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি গণগ্রন্থাগার বাতিঘর হিসেবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

এস এম শাহনূর প্রণীত 'নামকরণের ইতিকথা' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাব থাকায় রাজা লক্ষণ সেন আদিসুর কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এখানে নিয়ে আসেন। ব্রাহ্মণদের বসবাসের কারণেই জেলার নামকরণ 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া' হয়। জেলার নামকরণ নিয়ে অনেক মত থাকলেও এই মতটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। কেননা, আঞ্চলিক উচ্চারণে এ জেলাকে 'বাউনবাইরা' বলা হয়ে থাকে। শুধু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই নয়, স্বাধিকার আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া উজ্জ্বল। মুঘল আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মসলিন কাপড় তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। জেলার ছানামুখী মিষ্টি, তালের বড়া এবং রসমালাই এখনো বিখ্যাত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অনেক সংস্কৃতিজনের জন্ম হয়েছে। জেলার মনীষীরা তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকেই সমৃদ্ধ করছেন। ফলে, জেলার ওপর যে কোনো গবেষণা পরিচালনার জন্য গবেষকরা সরকারি এই গণগ্রন্থাগারের শরণাপন্ন হলে, জেলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের রচনাসহ বিশাল তথ্যের ভান্ডারে যুক্ত হতে পারবেন। বিশাল বইয়ের মজুদসহ গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে অবিরত পাঠক সেবা, রেফারেন্স সেবা, সাম্প্রতিক তথ্যজ্ঞাপন সেবা, পরামর্শ সেবা, নির্বাচিত তথ্য বিতরণ সেবা, তথ্য অনুসন্ধান সেবা, পুস্তক লেনদেন সেবা, পুরাতন পত্রিকা সেবাসহ নানা সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া, বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা এবং বেসরকারি গণগ্রন্থাগারসমূহকে রেজিস্ট্রেশন সেবা প্রদান করা হয়। গ্রন্থাগারে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ১১টি দৈনিক পত্রিকা এবং ৭টি সাপ্তাহিক ও মাসিক সাময়িকী পাঠের সুযোগ পাবেন পাঠকরা।

গ্রন্থাগারিক জানান, জ্ঞানপিপাসুরা যারা বই পাঠের জন্য এখানে নিয়মিত তাদের চাইলে সব ধরনের সহায়তা করা হয়। অন্যদিকে, গণগ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, বইপাঠ প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। এছাড়া, বিশেষ দিবসে গ্রন্থ প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন করা হয়ে থাকে গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে। এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য মূলত বই পাঠে উৎসাহিত করা।

ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নতুন নতুন পাঠাগার গড়ে উঠুক। মানুষ বইপ্রেমী হোক, বই পাঠের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ প্রাণের উদ্ভাসন ঘটুক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি গণগ্রন্থাগার এক্ষেত্রে উদ্যোগী হোক, এমনটি প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে