গৃহকর্মীদের সুরক্ষা আইন ও বাস্তবায়ন
আজকাল অল্পশিক্ষিত নারীদের জন্যও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। পোশাক কারখানায় কাজ করছেন বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক। তাছাড়া বাড়িতে ছোট ব্যবসা, হস্তশিল্প, চাষাবাদ, হাঁস-মুরগি পালন, সেলাই, নকশিকাঁথা প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু শিশুরা অভাবের কারণে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে বেশি। নির্যাতনের শিকার হলেও মুখ বুজে তা সহ্য করছে।
প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অলোক আচার্য
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গৃহকর্মী কল্পনার ওপর তার গৃহকত্রীর নৃশংস অত্যাচারের সংবাদ পড়ে বিস্মিত হতে হয়। সভ্য সমাজে এত নৃশংস মানুষ কীভাবে থাকতে পারে? এত ভদ্র জৌলুসের ভেতর এত নগ্ন হিংস্রতা ঠিক মানানসই না। আদিম যুগেও এত অত্যাচার হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। মেয়েটির হাত, বুক, পিঠ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সামনের দাঁত বিশ্রীভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং আরও অত্যাচার করা হয়েছে। ঠিক পৈশাচিক কায়দায়! বর্বরতা তো আর কল্পনাতে সীমাবদ্ধ নেই। এ রকম আরও ঘটনা আছে- যা প্রকাশ্যেই আসছে না। বিচার হচ্ছে না। বিচার চাওয়ারও সাহস হচ্ছে না। যেমনটা কল্পনারও হয়নি। ঘটনাক্রমে মেয়েটি বেঁচে গেল। না হলে মেয়েটির ওপর যে আরও কী চলতো তা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন। সমাজের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ দু'টি শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যায়। ধনিকশ্রেণি ও দরিদ্রশ্রেণি। এদের মধ্যে আবার প্রভু বা মালিক ও ভৃত্য এরূপ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক সময় ক্রীতদাস প্রথা প্রচলিত ছিল। সেই প্রথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঠে গেছে। কিন্তু এখনো কেউ কেউ সেই মানসিকতা ধরে রেখেছেন যারা আভিজাত্য আর অহংকারে গর্ববোধ করেন। আমাদের প্রতিদিনের ঘরের কাজে যারা সাহায্য করে তারাই গৃহকর্মী। তারা আমাদের সহযোগী। তারা আমাদের সহযোগী হলেও তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নিচু। যদিও সবক্ষেত্রেই একথা সত্য নয়। অর্থাৎ সবাই গৃহকর্মীদের ভৃত্য হিসেবে দেখে না। তবে মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় তাদের ওপর অমানসিক নির্যাতন করার খবর দেখে শিউরে উঠতে হয়। অবাক করা বিষয় হলো, যারা গৃহকর্মীদের নির্যাতন করেন তারা অধিকাংশই তথাকথিত হাই-সোসাইটির। যদিও উচ্চবিত্ত ছাড়া গৃহকর্মী নেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, সারা বিশ্বে প্রায় ৭ কোটি ৬০ লাখ মানুষ গৃহকর্মী পেশায় জড়িত। দেশে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে কেউ কেউ বলেন, ২৫ লাখের বেশি, কেউ বলেন দেশে ৭৫ লাখের বেশি গৃহকর্মী আছেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী গৃহকর্মী। তবে শহরে বাসাবাড়িতে স্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বা শিশু। গৃহকর্তার সঙ্গে ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মীর কোনো লিখিত চুক্তি নেই। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মী নিয়োগকর্তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২১ শতাংশ এবং মৌখিক নির্যাতনের শিকার ৬১ শতাংশ।
বিলসের আরেকটি সমীক্ষা বলছে, ৮৪ শতাংশ গৃহকর্মী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তার মানে মাসে তাদের আয় গড়ে ৫ হাজার ৩১১ টাকারও কম। এ ছাড়া ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৬২৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২২ সালে নির্যাতনে মৃতু্য হয় ১৫ জনের এবং গুরুতর আহত হন ১৮ জন। অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে বমসা। এতে দেখা যায়, ৩২ শতাংশ গৃহশ্রমিকের মাসে আয় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। ৪৫ শতাংশ নারী গৃহকর্মী তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিবন্ধ বলছে, গৃহশ্রমিকের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে একটি নীতি তৈরি করেছে সরকার। এরপর ৯ বছর হয়ে গেলেও পুরোপুরি এর বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থাৎ দেখা যায় যে, গৃহকর্মীরা নির্যাতিত হলেও মামলা হওয়ার ঘটনা তুলনামূলক কম। গৃহকর্মীরা আমাদের সংসারের যাবতীয় কাজ করলেও কেবল মানসিকতার কারণে তাদের সংসারের একজন না ভেবে বরং তার ওপর নির্যাতন করার সংবাদ প্রায়ই পড়তে হয়। এসব খবর বেশ উদ্বেগজনক। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় গৃহকর্মীরা। যারা এ ধরনের নির্যাতন করে তারা বিবেকসম্পন্ন শিক্ষিত এবং তথাকথিত উচ্চবিত্ত সমাজের শ্রেণিভুক্ত। সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে যে সাহেব-ভৃত্য মানসিকতা তৈরি হয়েছে সেখান থেকে আমরা আর বের হতে পারছি না। অর্থ দাপটে নিজেদের সেই অত্যাচারী জমিদার ভাবতে থাকি। এরা মূলত প্রভুসুলভ মানসিকতা থেকে কোনোদিনই বের হতে পারে না। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমের সঙ্গে জড়িত মানুষ।
জীবিকা নির্বাহের কারণে বা টিকে থাকার জন্য অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ বেছে নেয় এমন গৃহশ্রমিকের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পুরুষের মধ্যে শিশু বেশি। তারা কাজ হারিয়েছে এবং দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্র হয়েছে। গৃহকর্মীদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে শহরে আসে নিজের পরিবারকে একটু ভালো রাখার আশায় বা একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার আশায়। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সিরা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। শত কষ্ট সহ্য করেও তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। তারপরেও প্রায়ই পত্রপত্রিকায় গৃহকর্মী নির্যাতনের ভয়ংকর সব খবর প্রকাশিত হয়। তাদের সভ্য শিক্ষিত পরিবারে তাদের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তাদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। পত্রিকায় এসব খবর পড়ে ওদের জন্য কষ্ট হয়। কোনো কারণেই গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন করা যেখানে মানবতার চরম বিরোধী কাজ সেখানে অতি তুচ্ছ কারণেও ভয়ংকর নির্যাতন করে। সময়টা সভ্য হলেও আমরা সভ্য হতে পারিনি। যারা অন্যের বাড়িতে স্থায়ীভাবে কাজ করেন তারা অন্যের সংসার সামাল দিয়ে খুব কম সময়ই নিজের সংসারে দিতে পারেন। আবার যারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট কাজ করেন তারাও নিজের জন্য সময় পান সামান্যই। এত পরিশ্রমের পরেও তাদের শ্রমের জন্য কোনো মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর গবেষণায় বলা হয়, শতকরা ৫০ ভাগ গৃহপরিচারিকা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার। তাদের ৬০ শতাংশই শিশু। বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন। এই আত্মহত্যার বিষয়টি স্বাভাবিক আত্মহত্যা মনে করার কোনো কারণ নেই।
কঠোর পরিশ্রম করলেও গৃহকর্মীদের শ্রমের মূল্যায়ন আমরা কোনো দিন করিনি। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে জড়িত মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ- যার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ নারী। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশে দরিদ্র, অশিক্ষিত নারীর একটি অংশ যাদের জন্ম গ্রামে অথবা শহরের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা কোনো পরিবারে সেসব পরিবার থেকে গৃহকর্মী কাজ বেছে নেয়। তাদের গৃহশ্রমিক হয়ে ওঠার প্রধান কারণই থাকে অর্থ উপার্জন করা। নিজের জীবন টিকিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারকেও সাহায্য করা। তাদের কাজ পরিবারে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সেই পরিবারই বুঝতে পারে। অথচ তাদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহশ্রমিক নির্যাতন বন্ধে ২০১৫ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে আছে কোনো গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে হলে এক মাস আগে তা জানাতে হবে। গৃহকর্মীও যদি চাকরি ছাড়তে চায় তবে নিয়োগকারীকে তা এক মাস আগে জানাতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে বাদ দিলে এক মাসের মজুরি দেওয়ার বিধান করা রয়েছে। গৃহকর্মী অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে, তবে নিয়োগকারী নিজে তাকে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দিতে পারবেন না। এছাড়া, কোনো গৃহকর্মী যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকার তা পরিচালনা করবে। গৃহকর্মীর কাজের মূল্যায়ন তখন সম্ভব হবে যখন পরিবারে তার অবদানের মূল্যায়ন করা হবে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করলে তার কাজের স্বীকৃতি মেলে না। অথচ সে পরিবারের একজন সহায়তাকারী। পরিবারের সুখে-দুঃখে সেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। গৃহকর্মী হিসেবে যারা কাজ করছে তাদের একটি বড় অংশই শিশু। আবার নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীদের ৮০ শতাংশই শিশু। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ গৃহশ্রমিকের কাজ করেন। এর মধ্যে ৯৫ ভাগেরও বেশি নারী। যেসব গৃহকর্মী হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের বেশিভাগের বয়স ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে দেখা গেছে, গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং কারখানার নারী কর্মীদের ২০ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন।
আজকাল অল্পশিক্ষিত নারীদের জন্যও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। পোশাক কারখানায় কাজ করছেন বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক। তাছাড়া বাড়িতে ছোট ব্যবসা, হস্তশিল্প, চাষাবাদ, হাঁস-মুরগি পালন, সেলাই, নকশিকাঁথা প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু শিশুরা অভাবের কারণে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে বেশি। নির্যাতনের শিকার হলেও মুখ বুজে তা সহ্য করছে।
অনেক তথাকথিত হাই-সোসাইটি, শিক্ষিত পরিবারেই গৃহকর্মীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। যার কোনোটা প্রকাশিত হচ্ছে, আবার কিছু অন্তরালেই রয়ে যাচ্ছে। এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে হবে। গৃহকর্মীদের শ্রমের মর্যাদা দিতে তাদের নিয়োগ, বেতন নির্ধারণ, উৎসব ভাতার ব্যবস্থা, চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদির সঠিক বিধি প্রণয়ন করতে হবে। তাদের শ্রমের স্বীকৃতি দিয়ে এটিকে একটি পেশা হিসেবে গণ্য করতে হবে। গৃহকর্মী নির্যাতন রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেই সঙ্গে আমাদের প্রভুসুলভ মানসিকতার বদল করতে হবে। না হলে কল্পনার মতো আরও কত শিশু, বয়স্কা গৃহকর্মী নির্যাতিত হবে তা গুণে শেষ করা যাবে না।
অলোক আচার্য :প্রাবন্ধিক