মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্ব অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত পস্নাউপ্যান ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান ও সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলীয় ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। এ ছাড়াও কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপিস্নন বিভাগের গবেষক দল।
বাস্তব প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে উর্বর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবং পাট স্থানান্তরিত হচ্ছে অপ্রচলিত (লবণাক্ত, পাহাড়ি ও চরাঞ্চল) জমিতে। তা ছাড়া নগরায়ণ, শিল্পায়ান ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতি বছর প্রায় ০.৭ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমি। কিন্তু দেশের দক্ষিণের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল লবণাক্ততা ও খরা প্রবণ এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে পাট উৎপাদন মৌসুমে (মার্চ-জুলাই কোনো ফসল থাকে না বললেই চলে। খুলনার কিছু কিছু এলাকায় তিল চাষ হলেও বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা বা খরার ঝুঁকি রয়েছে। উপকূলীয় লবণাক্ততা, খরা ও এক ফসলি আমন পরবর্তী পতিত জমিতে অথবা চর এলাকায় কেনাফ চাষের সম্ভাবনা ও উৎপাদিত বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গবেষণা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপিস্নন বিভাগের গবেষক দল। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২ ও এইচসি-৯৫ কেনাফ জাত নিয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেখানে লবণাক্ততার জন্য পাট চাষ সম্ভব নয়, সেখানে অনায়াসেই কেনাফ চাষ সম্ভব এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ও গাছ বৃদ্ধির সময় কেনাফ ৮ থেকে ১৪ ডিএসমি. পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। গবেষণাগারে সফলভাবে কেনাফ খড়ি এবং আঁশ থেকে কাগজের মন্ড ও কাগজ এবং কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছে গবেষক দল। অনুরুপভাবে বিজেআরআই'র বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষের সফলতা পেয়েছেন। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতা থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ রাখে। পৃথিবীর বহুদেশে কাগজের মন্ড ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়। কেনাফ আঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, পেস্নন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য- শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড়চোপড় জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, সাটিং, সুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনসুলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেনাফের খড়ি অধিক পানি শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় তা বেডিং মেটারিয়ালসহ জ্বালানি ও উন্নতমানের চারকোল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কেনাফের বীজ থেকে ঔষধি গুণসম্পন্ন তেলও পাওয়া যায়।
কেনাফ পাটের ন্যায় পরিবেশবান্ধব আঁশজাতীয় ফসল। উষ্ণমন্ডলীয় ও অবউষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে আঁশ উৎপাদনের জন্য এ ফসল ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। উচু, নিচু, পাহাড়ি, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে বপন উপযোগী কেনাফ ফসলে পাটের চেয়ে নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি কেনাফ কাগজের মন্ড, বেস্নন্ডেড কাপড়, টেক্সটাইল, বিল্ডিং উপকরণ, বায়োকম্পোজিট, তৈল শোষক ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রায় পাট ও আঁশজাতীয় ফসলের অবদান প্রায় আট বিলিয়ন।