প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পাটের চাষ ও এর বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার হয়ে আসছে এবং বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ক্রমান্বয়ে প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিশ্বে পাট উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। উৎপাদনের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রোগ-বালাই ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণীর আক্রমণ থেকে মাঠের ফসল ও পাট রক্ষা করা একটা চ্যালেঞ্জ। মাঠের পাটবীজ উৎপাদন ও গুদামজাত আঁশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইঁদুর এক বড় সমস্যা।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায় যে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রম্নত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা- যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। মাঠের ফসল ছাড়াও এই অববাহিকায় অবস্থিত হাটবাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি।
ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর দাঁত অত্যন্ত তীক্ষ্নও ধারালো বাঁটালির মতো- যা জন্ম থেকে মৃতু্য পর্যন্ত বাড়তে থাকে। তাই ইঁদুরের দাঁতের গঠন ঠিক রাখার জন্য বা দাঁত ক্ষয় করার জন্য সবসময় কাটাকুটি করে। ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক্ত, নিশাচর প্রাণী। এদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও স্পর্শ, শ্রবণ, ঘ্রাণ ও স্বাদেন্দ্রীয় বেশ প্রখর। ইঁদুর যে কোনো পরিবেশে নিজেকে খাপখাইয়ে খুব দ্রম্নত বংশবিস্তার করতে সক্ষম। একজোড়া ইঁদুর হতে বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে গড়ে প্রায় ২০০০টি পর্যন্ত ইঁদুর জন্মলাভ করতে পারে। ইঁদুর সাধারণত গর্তে বাস করে, তবে কোনো কোনো প্রজাতি ঘরে বা গাছেও বাসা তৈরি করতে পারদর্শী। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী বিভিন্ন রোগের বাহক বা সংরক্ষক হিসেবেও কাজ করে, যেমন- পেস্নগ, মিউরিন টাইফাস, লেপটোস্পারোসিস, ইঁদুর কামড়ালে জ্বর সালমোনেলোসিস ইত্যাদি রোগ হতে পারে।
আমাদের মাঠ ফসল ও গুদামে যে কয়টি ইঁদুরের প্রজাতি বেশি ক্ষতি করে সেগুলো হলো- মাঠের বড় কালো ইঁদুর বা ধেড়ে ইঁদুর, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুরেরগোষ্ঠী, বাত্তি বা সোলই বা ঘরের নেংটি ইঁদুর, বাদামি ইঁদুর অন্যতম। এদের মধ্যে কালো ইঁদুর মাঠে ও গুদামে এবং মাঠের বড় কালো ইঁদুর নিম্ন ভূমির জমিতে বেশি আক্রমণ করে। ঘরে বা তার পাশে ইঁদুরের নতুন মাটি অথবা গর্ত, ফসলের মাঠে, আইলে ও জমির বাঁধ, পুল ইত্যাদির পাশে গর্ত দেখে ইঁদুরের উপস্থিতি বোঝা যায়। অধিকাংশ সময়ই ইঁদুর মাটি থেকে প্রায় ১০ সে. মি. উপরে পাট ফসলের কান্ড কেটে দেয়। কোনো কোনো সময় ইঁদুর শুধু তার দাঁতকে ধারালো এবং স্বাভাবিক রাখার জন্য অথবা বাসা তৈরি করার জন্য পাটগাছ কেটে টুকরো টুকরো করে থাকে। বীজ
গজানো থেকে শুরু করে পাটগাছ কাটা পর্যন্ত মাঠে ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। তবে, বীজ ফসলে ফুল আসার সময় থেকে পাটবীজ পরিপক্ক অবস্থা পর্যন্ত ক্ষেতে গর্ত, নালা ও প্রচুর পরিমাণে মাটি উঠিয়ে পাটক্ষেতে ক্ষতি করে। ফলে বীজের ফলন কমে যায়।
ইঁদুর গুদামজাত পাটআঁশে মলমূত্র ও লোমের সংমিশ্রণ করে, মানুষ ও গবাদি পশুদের মধ্যে রোগ-বালাই সংক্রমণ করে, সর্বোপরি পরিবেশ দূষিত করে। আমাদের দেশে যে পরিমাণ পাটআঁশ উৎপন্ন হয়, গুদামজাত করার পরে তার থেকে শতকরা প্রায় ৩ থেকে ৫ ভাগ আঁশ এই সম্মিলিত ইঁদুর বাহিনী দ্বারা নষ্ট হয়। একটি ইঁদুর প্রতিদিন ২৫ গ্রাম এবং একটি নেংটি ইঁদুর ৩ থেকে ৪ গ্রাম খাবার খায়। ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার খায়, তার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বেশি নষ্ট করে মলমূত্র, পশম ও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে- যা মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী করে। একটি ইঁদুর প্রতিদিন ২৫ থেকে ১৫০ বার মল ত্যাগ, ১৫ থেকে ২৫ মিলি. প্রস্রাব করে এবং প্রায় ১০০০টি পশম গায়ে থেকে ঝরে যায়- যা পাটআঁশের সঙ্গে মিশে গুণাগুণ নষ্ট করে। গুদাম ঘর কাঁচা হলে এরা গর্ত করে ঘরের দেয়াল ও মেঝে নষ্ট করে। ইঁদুরে কাটা পাটআঁশ, মেঝেতে ইঁদুরের পায়ের ছাপ, খোবলানো মেঝের ঝুরঝুরে মাটি, পড়ে থাকা ইঁদুরের মল, কাঠের তাকে বা দেয়ালে তেলতেলে দাগ প্রভৃতি দেখে ইঁদুরের আক্রমণ ও উপস্থিতি বুঝা যায়।
ইঁদুর দমনের জন্য বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। মূলত দমন পদ্ধতিনির্ভর করে উপস্থিত প্রজাতির ধরন, ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ, ফসলের অর্থনৈতিক মূল্য, দমনপদ্ধতির সহজপ্রাপ্যতা এবং আর্থসামাজিক অবস্থা সাপেক্ষে। অধিকন্তু, কোনো একক পদ্ধতি প্রয়োগ করার চেয়ে যৌথভাবে সমন্বিত বা সুসংহত দমন ব্যবস্থা নিলে অধিক কার্যকরী হয়। ইঁদুর খাবার না খেয়ে এক সপ্তাহ বাঁচতে পারে কিন্তু পানি ছাড়া তিন দিনের বেশি বাঁচতে পারে না কিন্তু নেংটি ইঁদুর পানি ছাড়া অনেকদিন বাঁচতে পারে। বসতবাড়ি ও গুদাম ঘরেও ইঁদুর দমন ব্যবস্থাকে প্রধানত দু'ভাবে ভাগ করা যায় অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মত দমন এবং বিষ প্রয়োগ বা রাসায়নিক দমন পদ্ধতি।
আদিকাল থেকে কোনো প্রকার বিষ বা বিষটোপ ছাড়া ইঁদুর দমন প্রচেষ্টা চলে আসছে। যথাসম্ভব পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে দমনব্যবস্থা নেওয়া শ্রেয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে বসতবাড়ি, রান্নাঘর, ভান্ডার, গুদামঘর, বাড়ির আঙিনা উচ্ছিষ্ট খাবার-দাবার, অবাঞ্ছিত আগাছা ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নির্মূল করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। দালানকোঠা, ঘরবাড়ি ও গুদামঘরে দরজা-জানালা, গ্রিল, পাইপের খোলা মুখ ও অন্যান্য ইঁদুর প্রবেশ স্থানের ফাঁকফোকরে ধাতব পাত বা তারজালি লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইঁদুরের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং চলাচল প্রতিহত করা সম্ভব। পানির ট্যাপের ছিদ্র, ভাঙা ড্রেন সর্বদা মেরামত করতে হবে যাতে ইঁদুরের জন্য পানি সহজলভ্য না হয়। সম্ভব হলে গুদামঘরের মেঝে পাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বসতবাড়িতে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরা একটি চিরায়ত আদি দমন পদ্ধতি। ইঁদুরের আকার আকৃতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ফাঁদ ব্যবহার করা সমীচীন। এসব ফাঁদ ইঁদুরের চলাচলের পথ বা আনাগোনাবহুল স্থান যথা: ঘরের কিনারায়, দেয়ালের পার্শ্বে, মাচায়, চালের ওপর বা গর্তের কাছাকাছি স্থাপন করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ফাঁদে ধৃত ইঁদুর যথাশিগগিরই সম্ভব সরানো হয় এবং পুরাতন, খারাপ ও মোল্ডযুক্ত টোপ সরিয়ে নতুন টোপ দেওয়া হয়। কোনো কোনো ফাঁদে ইঁদুর ধরা পড়ার সময়ই জাঁতাকলে আটকে মারা যায়। ইঁদুরের ফাঁদ ভীতি কাটানোর জন্য প্রথম ২ থেকে ৩ দিন এ ফাঁদের মুখ খোলা রেখে স্থাপন করা হয়। ধৃত জীবন্ত ইঁদুর পানিতে ডুবিয়ে মেরে এবং মৃত ইঁদুরগুলো মাটির গভীরে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। পরভোজী প্রাণীর মধ্যে দিবাচর শিকারি পাখি স্তন্যপায়ীপ্রাণী সরীসৃপ দৈনিক উখেযোগ্য সংখ্যক ইঁদুর শিকার করে ইঁদুরের আধিক্য কমায়। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব ইঁদুরভুক্ত উপকারি প্রাণিকুলের নির্বিচার নিধন বন্ধে ও সংরক্ষণে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বহুযুগ ধরে চলে আসছে। অরাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে, ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাধিক্য ঘটলে বিষ বা বিষটোপ ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিষ ক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে রাসায়নিক পদ্ধতিকে মূলত দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তীব্র বা তাৎক্ষণিক ইঁদুরনাশক খাওয়ার পর দেহে তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া দেখা দেয় এবং ইঁদুর মারা যায়। যেমন- জিংক ফসফাইড। বহুমাত্রা বা দীর্ঘ মেয়াদি ইঁদুরনাশক খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে বিষক্রিয়ায় মারা না গেলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ বা দুর্বল হয়ে ২-১৪ দিনের মধ্যে মারা যায়। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিষটোপ হলো গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড, গমে মিশ্রিত ব্রোমাডিয়লন, ল্যার্নিযাট, ব্রোমাপয়েন্ট, রেকুমিন।
যে সব ঘরে ইঁদুর আছে বলে মনে করেন অথবা নতুন মাটি তোলা গতের্র মুখে, ইঁদুর চলাচলের রাস্তার উপর বিষটোপ রেখে দিতে হবে। ছোট ঘর হলে ৪ থেকে ৫ স্থানে এবং বড় ঘর হলে ১৫ থেকে ২০ স্থানে বিষ রাখা প্রয়োজন। বিষটোপ প্রস্তুত ও ব্যবহারের পর হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। বিষটোপ ছোট ছেলেমেয়েদের ও গৃহপালিত পশুর নাগালের বাইরে রাখতে হবে। কখনো বিষ মুখে বা পেটে গেলে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সন্ধ্যার সময় বিষটোপ দিতে হবে এবং পরদিন সকালে সেগুলো আবার তুলে রাখতে হবে।
কোনো নির্দিষ্ট একক পদ্ধতি ইঁদুর দমনের জন্য যথেষ্ট নয়। ইঁদুর দমনের সফলতা নির্ভর করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের ওপর। অতএব, সমন্বিত, সম্মিলিত এবং সময়পযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই ইঁদুরের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যে সমস্ত প্রাণী মাঠফসল ও গুদামজাত পাটআঁশের ক্ষতি করে থাকে তাদের মধ্যে ইঁদুর অন্যতম। ইঁদুর আকারে ছোট হলেও সারা বছর সব ধরনের ক্ষতি মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে। এদের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ পরিসংখ্যানগতভাবে নির্ণয় করা স্বভাবতই কঠিন। আমাদের দেশে ফসল সংগ্রহের পর পাটআঁশ গুদামে সংরক্ষণ করা হয়, যেখানে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। সমন্বিত ও সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখে দমনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই মূল্যবান ফসল বা সম্পদ রক্ষাসহ অন্যান্য সেক্টরের নানাবিধ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।