রবি মৌসুমে সবজি চাষ ও রোগবালাই দমন কার্যক্রম

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ইমরান ছিদ্দিকি
মৌসুমে সবজি

কৃষিকাজে শীতের সময়টাকে রবি মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। নভেম্বর থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে রবি মৌসুম বলা হয়। এ সময়ে যেসব শস্য বা ফসলের চাষাবাদ করা হয় একে রবিশস্য, রবি ফসল বা চৈতালি ফসল বলে। রবি মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকে। বৃষ্টিপাতও কম হয় বলে জমিতে পানি সংকট দেখা দেয়। তাই এ সময় চাষাবাদে কৃষকদের বর্ষাকালের সঞ্চিত পানির ওপর নিভর্র করতে হয়। এ ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জমিতে সেচ দিতে হয়। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা প্রকৃতি ও মৌসুমি বায়ুর ওপর নিভর্রশীল। বাংলাদেশের ফসল উৎপাদনের জন্য জলবায়ুর ভিত্তিতে সারা বছরকে প্রধান দুটি মৌসুম যথা- রবি মৌসুম ও খরিপ মৌসুম হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। এ দুই মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ফসল জন্মে। রবি মৌসুমেও অনেক ধরনের ফসল চাষাবাদ করা হয়। বোরো ধান, গম, মসুর ডাল, যব, সরিষা, পেঁয়াজ, মোটরশুঁটি ইত্যাদি ফসলকে এ মৌসুমের প্রধান শস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, গাজর, লাউ, শিম, টমেটো ও আলু ইত্যাদি এ মৌসুমে চাষ করা হয়। রবি সবজির চারা রোপণ, চারার যত্ন, সেচ, সার প্রয়োগ, বালাই দমনসহ নাবী রবি সবজির বীজতলা তৈরি, বীজবপন, আগাম টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপির আগাছা দমন করতে হবে। শিম, লাউ, বরবটির মাচা তৈরি ও পরিচর্যা করতে হবে। রসুন, পেঁয়াজের বীজবপন, আলু লাগাতে হবে। ফল গাছের গোড়ায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার ও সার প্রয়োগ করতে। সবজি ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসলের বীজবপন বা চারা রোপণ থেকে শুরু করে ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রকার রোগবালাই আক্রমণ করে থাকে। বীজতলায় এ রোগ বেশি দেখা দেয়। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং আক্রান্ত চারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাটি সব সময় সঁ্যাতসেঁতে থাকলে, ক্রমাগত মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বিরাজ করলে এবং বায়ু চলাচলের বিঘ্ন ঘটলে এ রোগের আক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে। বপনকৃত বীজ এবং চারা উভয়ই ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বীজে আক্রমণ হলে বীজ গজায় না। চারায় আক্রমণ হলে প্রথমে আক্রান্ত চারা ফ্যাকাশে দেখা যায় এবং কান্ডের গোড়ায় বাদামি রঙের ভেজা দাগ দেখা যায়। পরে ভেজা দাগ কান্ডের চারিদিকে বিস্তৃত হয়। পরবর্তী সময়ে তা কান্ডের উপরে এবং নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। চারার কান্ড মাটির কাছাকাছি চিকন হয়ে পড়ে। চারার গায়ে ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়। আক্রান্ত অংশ পচে যায়। চারার গোড়া চিকন, লিকলিকে হয়ে ঢলে পড়ে এবং মারা যায়। এ জন্য সূর্যালোক এবং বায়ুময় স্থানে বীজতলা তৈরি করা। বীজতলা স্যাঁতসেঁতে হতে না দেয়া। বীজ পাতলা করে বোনা এবং বীজতলায় বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকা। এছাড়াও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা এবং একই বীজতলা বারবার ব্যবহার না করা উত্তম। সব সবজি ফসলে নেতিয়ে পড়া রোগ হতে পারে। ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া উভয় ধরনের জীবাণু দ্বারা এ রোগ সংক্রমিত হতে পরে। বাইরের লক্ষণ প্রায় একই রকম হবে ভেতরের লক্ষণে ভিন্নতা বিদ্যামান। ছত্রাকের আক্রমণে গাছের নরম অংশ যেমন কচি পাতা, ডগা প্রথমে দুপুরে রোদের সময় ঢলে পড়তে দেখা যায়। দুয়েক দিন পর সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে এবং মারা যায়। এ রোগের সঙ্গে গাছের পানির অভাবজনিত লক্ষণের তুলনা চলে। \হএজন্য রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। মাটি স্যাঁতসেঁতে হতে না দেয়া ও নিয়ন্ত্রিত সেচ দেয়া উত্তম। আক্রমণ ক্রমাগত হলে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। বেগুনের ক্ষেত্রে গ্রাফটেড চারা লাগালে রোগ হবে না। জমি তৈরির সময় একর প্রতি ৩ কেজি কার্বোফুরান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বা গাছের চারা লাগানের পূর্বে গোড়ায় ৫ গ্রাম ফুরাডান ৫ জি ব্যবহারে রোগের আক্রমণ কম হয়। পচন সবজি ফসলের একটি সাধারণ রোগ। ছত্রাকজনিত এই রোগ পাতায় এবং ফলে প্রথমে হলুদ বর্ণের ক্ষুদ্র দাগ হিসেবে প্রকাশ পায়। পরে এ সব দাগ দ্রম্নত বৃদ্ধি পেয়ে বাদামি বা কালো বর্ণ ধারণ করে। একাধিক দাগের সমন্বয়ে বড় দাগের সৃষ্টি হয়। গাছ নেতিয়ে পড়ে। ডাটা বা শাখা ফেটে যায় এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এ জন্য রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা এবং শস্য চক্র অনুসরণ করা। আক্রান্ত গাছ ও আক্রান্ত পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলা। প্রোভেক্স ২০০ বা ব্যাভিস্টিন (২-৩ গ্রাম/প্রতি কেজি বীজ) দ্বারা বীজ শোধন করা। কম নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ করা। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২ গ্রাম টপসিন এম ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা। আগা মরা রোগ মরিচসহ কিছু ফসলে দেখা দেয়। ছত্রাক প্রধানত গাছের শাখার অগ্রভাগ আক্রমণ করে গভীর দাগের সৃষ্টি করে পরিবাহী টিসু নষ্ট করে দেয়। ফলে, শাখার অগ্রভাগ উপরের দিক থেকে মরতে মরতে নিচের দিকে অগ্রসর হয় আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়। ছত্রাক পাকা ফলও আক্রমণ করে। আক্রান্ত ফলে প্রথমে কালো গোলাকার দাগ সৃষ্টি করে। ক্রমে ইহা ফলের দৈর্ঘ্য বরাবর লম্বা হতে থাকে এবং মেটো বর্ণ ধারণ করে। এ জন্য আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলা। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করা। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২ গ্রাম টপসিন এম ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা। সীম জাতীয় সবজিতে মরিচা রোগ বেশি হয় পাতার নিচে সাদা অথবা হলুদ দাগ দেখতে পাওয়া যায়। পরে সেগুলো লালচে বা মরিচা রং ধারণ করে। পরে পাতা মারা যায়। এ জন্য রোগ প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার করা। আক্রান্ত অংশ ধ্বংস করা। শস্য পর্যায় অবলম্বন করা। সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক বা ডাইথেন এম ৪৫ ০.২ শতাংশ হারে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা। কান্ড পচা রোগ অনেক সবজি ফসলে এ রোগ দেখা দেয়। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। রোগের আক্রমণের ফলে প্রথমে গাছের গোড়ায় এবং কান্ডে বাদামি হতে কালো রংয়ের দাগ পড়ে। এ দাগগুলো লম্বালম্বিভাবে বৃদ্ধি পেয়ে কান্ডের চারিদিকে বিস্তার লাভ করে। ফলে কান্ড পচে গাছ মরে যায়। আক্রান্ত স্থানে সাদা সূতার মতো রোগ জীবাণু খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। মাটি বেশি সঁ্যাতসেঁতে থাকলে এ রোগ বিস্তার লাভ করে এবং অন্য গাছকে আক্রমণ করে। এ জন্য রোগমুক্ত বীজ এবং চারা ব্যবহার করা। আইল সঁ্যাতসেঁতে হতে না দেয়া। রোগাক্রান্ত গাছের গোড়ায় ছাইমিশ্রিত পটাশ সার ব্যবহার করা। কুপ্রাভিট-৪ মিলি বা চ্যাম্পিয়ন ২ গ্রাম বা টিল্ট ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করা। পাতা কুকড়ে যাওয়া বা লিফ কার্ল এটি সবজি ফসলের একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগের আক্রমণে পাতার কিনারা উপরের দিকে বা নিচের দিকে মোচড়িয়ে যায়। পাতার শিরাগুলো স্বচ্ছ হয়ে উঠে। মোচড়ানো পাতা সুস্থ পাতার চেয়ে ঘন হয় এবং খসখসে ও শক্ত হয়ে যায়। ফল কম ধরে এবং বড় হয় না। এ রোগ প্রতিরোধে রোগমুক্ত ও রোগ প্রতিরোধী বীজ ব্যবহার করা। রোগাক্রান্ত গাছ শিকড়সহ তুলে পুড়ে ফেলা। ভাইরাসের বাহক জাব পোকা, জ্যাসিড পোকা দমনের জন্য ডায়ামেথেয়ট, এসাটাফ, এডমায়ার প্রভৃতির যে কোনো একটি ব্যবহার করা। আক্রমণ বেশি হলে শস্য পর্যায় অবলম্বন করা। শিকড়ে গিট বা রুট নট এটি একটি কৃমিজনিত রোগ। প্রায় সব সবজি ফসলে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছের শিকড়ে গিটের সৃষ্টি হয়। গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কম হয় এবং ফলন কম হয়। সুস্থ গাছের তুলনায় আক্রান্ত গাছ খাটো ও নিস্তেজ হয়। আক্রামণের ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে গাছের পাতা মরে যায় এবং ক্রমে গাছও মরে যায়। এ জন্য রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করা। শস্য পর্যায় অবলম্বন করা। মুরগির বিষ্টা, কাঠের গুঁড়া বা কম্পোস্ট সার মাটিতে ব্যবহার করা। ফুরাডান ৫জি থেকে ৮ কেজি/হে বা ৫ গ্রা/পিট হিসেবে বীজ বা চারা রোপণের পূর্বে ব্যবহার করা। নাবী ধ্বসা বা লেট বস্নাইট আলু ও টমেটোতে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। আকাশ মেঘলাসহ গুটি গুটি বৃষ্টিপাত হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। রোগের আক্রমণের ফলে, প্রথমে পাতায় ফ্যাকাশে সবুজ রঙের দাগ পড়ে। পরবর্তী পর্যায়ে দাগগুলো বড় হয়ে কালো বা বাদামি রং ধারণ করে। আক্রান্ত পাতা পচে যায়। পাতা ভেতরের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়। ফলের গায়ে দাগ পড়ে ও পচন ক্রিয়া দেখা দেয়। শুষ্ক আবহাওয়ায় আক্রান্ত অংশ মরে যায় কিন্তু আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ কান্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছ ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। এভাবে এ রোগ অন্য গাছও আক্রমণ করে। এজন্য রোগমুক্ত সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও বীজ শোধন করা উত্তম। পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। মাটি সঁ্যাতসেঁতে হতে দেয়া যাবে না। রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষাবাদ করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ম্যানকোজেব ২.৫ গ্রাম হারে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা। মেঘলা আবহাওয়ায় রিডোমিল গোল্ড, করমিল, মেটারিল, নিউবেন, সিকিউর, মেলোডি ডুও এর যে কোনো একটি ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহে স্প্রে করা। লেখক: ইমরান ছিদ্দিকি, সম্পাদক-দৈনিক সংলাপ।