অল্প পুঁজিতে স্ট্রবেরি চাষে অধিক লাভ
প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ইমরান ছিদ্দিকি
আধুনিক পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষ করে অল্প পুঁজিতেই অধিক লাভবান হওয়া যায়। বাংলাদেশে অক্টোবর থেকে নভেম্বর দুই মাস স্ট্রবেরির চারা লাগানোর জন্য উপযুক্ত। স্ট্রবেরি মূলত মৃদু শীত প্রধান অঞ্চলের ফসল। কিন্তু কিছু কিছু জাত তুলনামূলক তাপ সহিষ্ণু; এদের গ্রীষ্মায়িত জাত বলা যায়। অধিক লাভ ও উচ্চ বাজারমূল্যের কারণে স্ট্রবেরি চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। অনেকেই এক যুগের বেশি সময় স্ট্রবেরি চাষ করছেন। পেয়েছেন সফলতা। বাংলাদেশে এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে বিদেশি ফল স্ট্রবেরি। ফলন, বাজার চাহিদা ও দাম ভালো হওয়ায় দেশের কৃষকরা স্ট্রবেরি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কৃষকরা বলছেন, এক বিঘা জমিতে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় স্ট্রবেরি চাষে সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।
বর্তমানে বাংলাদেশের যে সব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও বেশি দিন স্থায়ী থাকে সেসব এলাকায় বারি স্ট্রবেরি-১ নামে উচ্চফলনশীল জাতের স্ট্রবেরি চাষ করা হচ্ছে। স্ট্রবেরির পাকা ফল টকটকে লাল রঙের হয়। এ ফলটি সুগন্ধীযুক্ত, টক মিষ্টি স্বাদের। জমির পাশাপাশি টব, বাড়ির ছাদ বা বারান্দায় এ ফল চাষ করা সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, শ্রীমঙ্গল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্ট্রবেরি চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। পঞ্চগড়, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, নাটোরেও চাষ হয়।
স্ট্রবেরি একটি অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু ফল। ফলটি দেখতে অনেকটা লিচুর মতো। স্ট্রবেরি জীবন রক্ষাকারী নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, ই, ফলিক এসিড, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম, পলিফেনল, এলাজিক এসিড, ফেরালিক এসিড, কুমারিক এসিড, কুয়েরসিটিন, জ্যান্থোমাইসিন ও ফাইটোস্টেরল। এদের মধ্যে এলাজিক এসিড ক্যানসার, বার্ধক্য, যৌনরোগ প্রতিরোধের গুণাগুণ আছে।
এক হিসাবে দেখা গেছে যে ১ বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করলে খরচ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা এবং ছয় মাসে আয় হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ১ বিঘা জমিতে প্রয়োজনীয় ৬ হাজার চারার মূল্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত দেড় হাজার কেজি স্ট্রবেরির প্রতি কেজির মূল্য ধরা হয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ঢাকার বিভিন্ন সুপার মার্কেটগুলোতে বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে আসা স্ট্রবেরি পাওয়া যায়। বর্তমানে যার প্রতি কেজির মূল্য ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা।
স্ট্রবেরি রানারের (কচুর লতির মতো লতা) মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে তুলে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে। ওই গাছ থেকে উৎপন্ন রানারের শিকড় বের হলে তা কেটে ৫০ ভাগ গোবর ও ৫০ ভাগ পলিমাটিযুক্ত পলিথিন ব্যাগে লাগাতে হবে। এরপর পলিথিন ব্যাগসহ চারাটি হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য চারার উপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে। রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই জাতের ফলন ক্ষমতা অক্ষুণ্ন্ন রাখার জন্য টিসু্য কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্যবহার করা ভালো।
জমি ভালোভাবে চাষ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে অন্তত ৩০ সেন্টিমিটার গভীর করে জমি চাষ দিতে হবে। যেহেতু স্ট্রবেরি গাছের শিকড় মাটির উপর দিকে থাকে সেজন্য মাটি ঝুরঝুরে করে নির্ধারিত মাত্রায় সার মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিত হবে। স্ট্রবেরির চারা মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যায়। তবে নভেম্বর মাস স্ট্রবেরি চারা রোপণের জন্য সবচেয়ে ভালো। জমি তৈরির পর লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ৫০ সেন্টিমিটার ও প্রতি সারিতে ৩০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে স্ট্রবেরির চারা লাগাতে হয়। বৃষ্টি হলে ক্ষেত থেকে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে দিতে হবে- না হলে গাছ পঁচে যাবে। স্ট্রবেরির জন্য দরকার প্রচুর জৈব সার। এজন্য প্রতি একরে ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া সার, ৭০ কেজি টিএসপি সার এবং ৮০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এসব সারকে সমান দুভাগে ভাগ করে একভাগ দিতে হয় ফুল আসার একমাস আগে এবং অন্য ভাগ দিতে হবে ফুল ফোটার সময়। ফল ধরা শুরু হলে ২-৩ দিন পর পরই সেচ দিতে হবে।
স্ট্রবেরি গাছে ফুল ধরাতে চাইলে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। গাছ লাগানোর পর তার গোড়া থেকে প্রচুর রানার বা কচুর লতির মতো লতা বের হতে থাকে। এগুলো জমি ঢেকে ফেলে। এতে ফলন ভাল হয় না। এসব লতা যাতে কম বের হয় সেজন্য গাছের গোড়ায় খড় বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হয়। পলিথিন সিট ৩০ সেন্টিমিটার পর গোলাকার ছিদ্র করে স্ট্রবেরি গাছের ঝোপকে মুঠো করে ঢুকিয়ে দিতে হয়। বেশি ফলন ও তাড়াতাড়ি ফল পেতে হরমোন গাছ পাতায় স্প্রে করা যেতে পারে। কাঁচা ফল যখন হলদে বা লালচে রঙের হতে শুরু করে তখন বুঝা যাবে ফল পাকা শুরু হয়েছে। ফল পুরো পাকলে লাল হয়ে যায়। তবে বিক্রির জন্য ফল পুরো লাল হওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে ফলগুলো শক্ত থাকা অবস্থায় তুলতে হবে। আর ফল তুলতে হবে বোটা সমেত। পরে কাগজের প্যাকেটে করে বাজারজাত করতে হবে।
যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত কাজীপুর উপজেলার কৃষিজমি পলিমাটি সমৃদ্ধ, কম খরচ ও পরিচর্যায় এখানে অধিক ফসল ফলান কৃষকরা। উপজেলার গান্ধাইল গ্রামের শিক্ষিত তরুণ রাসেল তার পারিবারিক দুই বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষের উদ্যোগ নেন। মৌসুমের শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করে রোপণ করেন এবং ইন্টারনেট ও সিরাজগঞ্জের সফল একজন স্ট্রবেরি চাষির পরামর্শ অনুযায়ী সার, পানি ও পরিচর্যা করতে থাকেন। দুই মাস পর থেকে ফল আসতে শুরু করে। রাসেল বলেন, দুই বিঘা জমিতে ১০ হাজার চারা রোপণ করি, চারার মূল্য, সার, পানি, পরিচর্যা ও অন্যান্য বাবদ ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দুই বিঘা জমিতে ২ হাজার কেজি স্ট্রবেরি উৎপাদন হবে আশা করছেন তিনি। গড়ে ৫০০ টাকা কেজি মূল্যে বিক্রি করলেও ১০ লাখ টাকা আয় হবে বলে তিনি জানান।
গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া উপজেলার দুটি গ্রামে স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। শ্রীপুরের বরামা এবং কাপাসিয়ার সিংহশ্রী এলাকায় এই চাষের বিস্তৃতি ঘটছে। বরামা গ্রামের রুবেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন। তিনি স্ট্রবেরি চাষ করে সফল হয়েছেন। রুবেল জানান, ছয় বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করেন। চার কাঠা থেকে উৎপাদিত স্ট্রবেরি সাড়ে তিন লাখ টাকা বিক্রি করেন। দ্বিতীয় বছরে নিজেই চারা সংরক্ষণ করেন। এভাবে বছরের পর বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করে সফল তিনি। এ বছর সাত কাঠা জমিতে চাষ করেছেন। তার গাছে কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, উইন্টারডন জাতের স্ট্রবেরি চারা গাছ গাজীপুরের পরিবেশের সঙ্গে ভালো ফলন দেয়। এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি, ফলের রং উজ্জ্বল এবং আগে উৎপাদন হয়। ফেস্টিভাল জাত দেরিতে উৎপাদন হয়। ফলে বৃষ্টি ও বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উইন্টারডন জাতের একটি চারা গাছ থেকে মৌসুমে কমপক্ষে দুই কেজি ফল পাওয়া যায়। চার কাঠা জমিতে ৫ হাজার স্ট্রবেরি চারা রোপণ করা যায়। এক কাঠা জমিতে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। তিনি বলেন, কার্তিক মাসে জমিতে রোপণ করতে হয়। পৌষের মাঝামাঝি সময় থেকে ফল আসে। চৈত্র মাস পর্যন্ত ফল বিক্রি করা যায়। গত বছর দুই লাখ টাকা খরচ করে ৫ কাঠা জমি থেকে ৬ লাখ টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করেছি। এবার ৭ কাঠা জমি থেকে আরও বেশি আয়ের প্রত্যাশা রয়েছে আমার।