বাংলাদেশে তুলা চাষে সাফল্য ও সম্ভাবনা

প্রকাশ | ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
নতুন জাত উদ্ভাবন ও চাষ এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে তুলা উৎপাদন পাঁচগুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে তুলার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা। তুলা একটি অর্থকরী ফসল। বস্ত্র শিল্পে তুলার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮.৫ মিলিয়ন বেল তুলার বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে বছরে ০.২ মিলিয়ন তুলা বেল কম উৎপাদন করে। অথচ তুলা এবং বস্ত্র উৎপাদনে বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। মধ্যযুগে বাংলা সূক্ষ্ন সুতার মসলিনের জন্য বিখ্যাত ছিল। মসলিন শাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা চাষ করা হতো ঢাকার আশপাশের উঁচু জমিতে যেখানে বেশিরভাগ তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। অধিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিল এবং অন্যান্য ব্যবহারকারীরা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকান, মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল ও পাকিস্তান থেকে তুলা আমদানি করে থাকে। নতুন উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাত ব্যবহার করে সমতল এলাকার কয়েকটি জেলার পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের বিস্তীর্ণ কম উর্বর জমি ব্যবহার করে দেশীয় তুলা উৎপাদন ১০ লাখ বেলে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে ঝিনাইদহ, যশোর জেলা সমতল, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কিছু অংশ পার্বত্য জেলা যেখানে দেশে বর্তমানে তুলা উৎপাদন করা হচ্ছে। খাগড়াছড়িকে অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর যশোর, বৃহত্তর কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং তিনটি পার্বত্য জেলাকে নিয়ে ১৩টি জোনে ২৭টি খামারভিত্তিক পরীক্ষামূলত চাষাবাদ পরিচালনা করছে। সিডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তুর্কি জাত তুলার উন্নয়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি শীর্ষক একটি প্রকল্পের অধীনে ১২টি উচ্চফলনশীল তুর্কি তুলার জাতের জার্মপস্নাজমের পরীক্ষা এখন গবেষণা খামারগুলোতে চলছে। হাইব্রিড ও বিটি তুলার চাষ করতে পারলে বছরে দেশে ১৫ লাখ বেল তুলা উৎপাদন সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, দেশে বছরে ৮৫ লাখ বেল তুলার প্রয়োজন হয়, আর উৎপাদন হয় ২ লাখ বেল। চাহিদার কমপক্ষে ২০ শতাংশ বা ১৫ লাখ বেল তুলা দেশে উৎপাদন করার সুযোগ রয়েছে। সে লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশে তুলার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগামীতে আরও বাড়বে। বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণকর্মীসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে দেশেই চাহিদার ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদন করা যায়। বিটি তুলা চাষ করে বিশ্বের অনেক দেশ আমদানিকারক দেশ হতে রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিটি তুলার চাষ করা হয় এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০০২ সালে বিটি তুলার চাষ শুরু হয়। বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুযায়ী সব গবেষণা কার্যক্রম সমাপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে, ২০২৩ সালের ৭ মে ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি কর্তৃক ভারতের জে কে এগ্রি-জেনেটিক্স লিমিটেডের উদ্ভাবিত দুটি তুলার জাত জে কে সি এইচ ১৯৪৭ বিটি এবং জে কে সি এইচ ১৯৫০ বিটি মাঠ পর্যায়ে অবমুক্তির জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিটি তুলার গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৪৫০০ কেজি। বিটি তুলা চাষে বলওয়ার্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় ১২-১৫ শতাংশ কমবে এবং উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ বাড়বে। বিটি তুলা চাষে প্রাকৃতিক দূষণ কম ও কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। বর্তমানে হাইব্রিড তুলা চাষ লাভজনক। দুই বিঘা তুলা চাষে এক লাখ টাকারও বেশি আয় করতে পারেন কৃষকরা- যা বর্তমান বাজারে লাভজনক। এছাড়াও, তুলার বীজবপনের পর প্রথম দেড় মাস স্বল্পকালীন শাক-সবব্জি (যেমন: লাল শাক, ডাটা শাক), মসলা জাতীয় ফসল (যেমন: গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, ধনেপাতা) এবং ডাল জাতীয় ফসল (যেমন: মুগ, মাষকলাই) আবাদ করে চাষিরা বাড়তি আয় করতে পারেন। বর্তমানে এক কেজি তুলা উৎপাদনের ফলে তিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয় এবং প্রতি টন বীজতুলা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্যতেল, খৈল ও জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। তুলা বীজ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোজ্যতেল পাওয়া যায়- যা উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর। শস্যবিনাসে তুলা চাষের পর একই জমিতে বোরো ধান, আউশ ধান, ভুট্টা, মুগ, তিল বিভিন্ন এলাকায় লাভজনকভাবে আবাদ করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার অন্য ফসলের মতো তুলা উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড করা হয়েছে। সারা বিশ্বেই তুলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। সেখানে দেশে তুলার উৎপাদন মাত্র দুই লাখ বেলের মতো। আগে এক লাখ বেলের নিচে উৎপাদন হতো। সম্প্রতি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের হাইব্রিড উন্নত জাতের তুলা উদ্ভাবন ও চাষের ফলে তুলা উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানিতে বছরে ২৪ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। যদিও আমদানিকৃত তুলা ভ্যালুঅ্যাডের মাধ্যমে সুতা ও কাপড়ের আকারে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব তুলা এ দেশে উৎপাদন করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। তুলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা ও অর্থনীতি। এটি আমাদের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা, বস্ত্রের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। তুলার ইতিহাস পৃথিবীতে ৭ হাজার বছরের পুরাতন। আর্য যুগ থেকে ব্রিটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো, ঘরে ঘরে চরকায় সুতা তৈরি হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাতো। দেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছায় ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। এটি দেশে তুলা গবেষণা, তুলা চাষ সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। চলতি মৌসুমে ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার বেল আঁশ তুলা। খাদ্য উৎপাদনে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে তুলা চাষ সম্প্র্রসারণ করা হচ্ছে। তামাক, লবণাক্ত, চর ও বনাঞ্চল এলাকায় তুলা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বিশ্বে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলা চাষ করা হয়। বিশ্বে তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ৪০তম অবস্থানে রয়েছে। তুলা উৎপাদনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ব্রাজিল অন্যতম। তুলার ইতিহাস অনেক দিনের। ব্রিটিশ আমলের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো, ঘরে ঘরে চরকায় সুতা তৈরি হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাত। বিশ্ব বিখ্যাত মসলিন কাপড় ও অন্যান্য সুতি বস্ত্র সমগ্র ইউরোপে রপ্তানি হতো। বিনিময়ে এসেছে বহু মূল্যবান ধাতু। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে এক লাখ সাতাত্তর হাজার বেল তুলা উৎপাদিত হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চাষ উপযোগী জমি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭৯ লাখ হেক্টর এবং তুলার উন্নত জাত ও হাইব্রিড জাত তৈরির জন্য নেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রকল্প। তুলাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর গবেষণা, সংরক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে। সব কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশেই ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদন ২০৪১ সালের মধ্যেই সম্ভব হবে। জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে নতুন এ জাতটি সহজেই চাষ করা যাবে। এজন্য খুব বেশি সেচের প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া এটি চরম জলবায়ুসহনশীল একটি জাত। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অন্যান্য জাতের তুলনায় এ জাতের তুলা অন্তত ৩০ দিন আগে সংগ্রহ করা যায়। এর পাশাপাশি উৎপাদনে কম জায়গা লাগে। নতুন জাতটি সম্ভাব্য হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় সাড়ে ৫ টন। অন্য জাতের হেক্টরপ্রতি ফলন ৪ টন। তুলা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। বর্তমান বার্ষিক জিডিপির ১১.১৬ শতাংশ আসে এই বস্ত্র খাত থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই সেক্টরে আয় করেছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ তুলা আমদানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয়। আফ্রিকা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ উলেস্নখযোগ্য দেশ থেকে তুলা আমদানি করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জমিস্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কখনো সম্ভব নয়। এমনকি চাহিদার অর্ধেক উৎপাদন করাও অসম্ভব। বর্তমান বাস্তবতায় জোর চেষ্টা চালালে চাহিদার সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ তুলা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে বোর্ডের ব্যর্থতা, সরকারের সহযোগিতার অভাব, গবেষণায় অবহেলার কারণে এই পরিমাণ তুলাও উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তারা বলছে দেশে তুলা চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই, আবার জমি তুলার উপযোগীও না। দেশের উৎপাদিত তুলা নিম্নমানের। রপ্তানির উপযোগী নয়। দীর্ঘদিন ধরে সরকার বোর্ডের পেছনে অর্থ খরচ করছে। ভবিষ্যতে এভাবে অর্থের অপচয় করবে কিনা, ভেবে দেখা দরকার। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের সুতার জোগান দিতে প্রচুর তুলা লাগে। বর্তমানে দেশের ৪৫০টি স্পিনিং মিলের চাহিদার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে জোগান দেওয়া যায়। তুলা উৎপাদনে শেষের সারিতে থাকলেও আমদানিতে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি করে চীন। তারপরেই বাংলাদেশ। ২০৩১ সালে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে তুলার চাহিদা বাড়বে ৬০ শতাংশ। একই সময়ে চীনে তুলার আমদানি বাড়বে ৮ শতাংশ। গড়ে তুলার বার্ষিক উৎপাদন বাড়বে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। ফলে ২০৩১ সালে বৈশ্বিক তুলার উৎপাদন হবে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টন- যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি।