বাংলাদেশ থেকে চিংড়ির পরই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে কাঁকড়া। কাঁকড়ার শক্ত খোলসের মধ্যে নরম খোসার কাঁকড়া চাহিদা বিদেশে বাড়ছে। বিশ্ব বাজারে চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশেও চাষ হচ্ছে কাঁকড়া। নরম খোসাযুক্ত কক্সবাজার সামুদ্রিক কাঁকড়া বিশ্বের প্রায় ৩৪টি দেশে রপ্তানি করে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন কাঁকড়া চাষে।
বাংলাদেশে যেসব জেলায় সফ্টশেল কাঁকড়া উৎপাদিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলা। সফ্টশেল কাঁকড়ারই বেশি চাহিদা এখন। বছরে এটাই প্রায় দুই হাজার টনের মতো উৎপাদিত হয়। এমনকি কাঁকড়া যেটা হার্ড থাকে সেটা খাওয়াটা বেশ কষ্টকর। আর এটার যেহেতু শেল থাকে না, সফট হয়ে যায় পুরো বডিটা, তাই যে কোনো বয়সের মানুষ এটা খেতে পারেন। বিশ্বের অনেক দেশেই খাবার হিসেবে কাঁকড়ার চাহিদা রয়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু খুলনা অঞ্চল থেকে ৬২২ টন সফ্টশেল কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৮৬ লাখ ৯৮৮মার্কিন ডলার। মূলত যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশ এবং সিঙ্গাপুরে সফ্টশেল কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়।
বাগদা চিংড়ির মতোই কাঁকড়া উপকূলীয় লবণাক্ত পানিতে চাষ করা হয়। ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল কাঁকড়া চাষের জন্য উপযোগী। নরম দো-আঁশ বা এঁটেল মাটিতে কাঁকড়া চাষ হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে এই কাঁকড়া চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া উপকূলীয় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ এবং সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় শিলা কাঁকড়ার দেখা মেলে। তবে খুলনা এবং চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় এদের বেশি দেখা যায়। সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার পুরোটা জুড়েই কাঁকড়া চাষ হয়। এর মধ্যে হরিনগর, মুন্সীগঞ্জ গ্রাম, এবং নয়াদীঘির এলাকাগুলোতে বেশি পরিমাণ কাঁকড়া চাষ হয়। নদীর মোহনা বা সাগরের জোয়ারের পানির সঙ্গে বিভিন্ন আকারের কাঁকড়া আসে। এর মধ্যে ছোট ছোট কাঁকড়া বা কিশোর কাঁকড়া সংগ্রহ করে ঘেরে রেখে বড় করা হয়। আর বড় কাঁকড়া এলে সেগুলো ধরে বিক্রি করা হয়। চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়া চাষে সময় কম লাগে। একই সঙ্গে কাঁকড়ার রোগ-বালাইও চিংড়ির চেয়ে কম হয়।
উপযোগী পরিবেশ, ভাইরাসমুক্ত ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় দিন দিন কাঁকড়ার চাষ ও খামার বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। বিশেষ করে চিংড়িতে ভাইরাস, রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষিরা ঝুঁকছেন কাঁকড়া চাষে। ব্যাপক চাহিদার কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকার কৃষকদের মধ্যে কাঁকড়া চাষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের প্রায় ৩৪টি দেশে যাচ্ছে এই কাঁকড়া। বছরে গড়ে আয় করছে প্রায় ৫শ' কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষের। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে দেশের পাঁচ উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ। চার প্রজাতির শিলা কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে এসব এলাকায়। এর মধ্যে রয়েছে সাইক্লা সের্রাটা, সাইক্লা, ট্রানকোবারিকা, সাইক্লা পরমামোসেইন এবং আইএসসিএল্পোলিভিসিয়া কাঁকড়া। গত অর্থবছরে দেশের ৯ হাজার ৮৫৪ হেক্টর উপকূলীয় এলাকায় ১১ লাখ ৭৮৭ মে. টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছে।
জানা গেছে, মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। চিংড়ির বদলে দেশের পাঁচ উপকূলীয় জেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাঁকড়ার। এটি চাষে চিংড়ির মতো বেশি দামে পোনা কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই সাগরের লোনাপানিতে জন্মায় কাঁকড়া। জোয়ারে নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই লাখ লাখ পোনা আপনাআপনিই উঠে আসে। যেসব গ্রামের শতভাগ মানুষেরই জীবিকা ছিল সুন্দরবন-কেন্দ্রিক। তা গত কয়েক বছরের ব্যবধানে কাঁকড়া চাষে সেই সব গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে। এখন আর তাদের সংসারে কোনো অভাব নেই। আধুনিক পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করে এ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছে।
সরকারি একটি গবেষণায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঁকড়ার বাজার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সালে সনাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পুকুরে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে হংকংয়ে কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানির মাধ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা। বর্তমানে শুধু মালয়েশিয়ায়ই প্রতি বছর ১০০ থেকে এক হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ মোট ৩৪টি দেশের বাজারে বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে।
চাষিরা বলছেন, উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সারা জাগিয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকের মুখে ফিরেছে হাসি। কাঁকড়া চাষে জায়গা কম লাগে, খরচও অল্প। বালাইয়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলাতে চলতি বছর ৩০৮ হেক্টর জমিতে ২৮ লাখ খাঁচায় কাঁকড়া চাষ হয়েছে। সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ধরে এনে খাঁচায় ছাড়া হয়। দশ-বারো দিনে খোলস পাল্টায় কাঁকড়া। চিংড়ি চাষের চেয়ে কাঁকড়া চাষে জনবল বেশি লাগায় দিন দিন এ জেলাতে কমছে বেকারত্ব। চাষিরা বলছেন, পস্ন্যাস্টিকের খাঁচায় একটি কাঁকড়া দুই-তিন সপ্তাহ পরিচর্যার পর তার খোলস পরিবর্তন করা হয়। এতে কাঁকড়ার ৮০ ভাগ ওজন বৃদ্ধি পায়। প্রকার ভেদে ড্রতি কেজি কাঁকড়া ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে সাতক্ষীরায় চাষ হওয়া এসব কাঁকড়া ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান মৎস্য কর্মকর্তারা। গেল অর্থবছরে সাতক্ষীরায় ২৫০ হেক্টর জমিতে কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ২০০ টন।
সুন্দরবন এলাকাতেও সহস্রাধিক প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ সীমানায় ১২ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। এসব কাঁকড়ার মধ্যে মাইলা, শাইলা, সিরোটা ও শীলা প্রজাতি। মাইলা ও শীলা জাতের কাঁকড়া সবচেয়ে উন্নতমানের, তাই বিদেশে এগুলোর চাহিদা বেশি। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কাঁকড়ার মৌসুম। বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু সরকারিভাবে এটি এখনও রপ্তানি পণ্য হিসেবে গণ্য হয়নি। কাঁকড়া আহরণ পরিবেশের ক্ষতি করে এ যুক্তিতে সরকার ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাঁকড়ার বাজার দখল করে নেয় ভারত, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন পরে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সরকার রপ্তানির অনুমতি দিলেও আহরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। ২০ বছর ধরে রপ্তানি হতো মূলত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কাঁকড়া। চাষিরা নদী, সাগর, ডোবা, জলাশয় থেকে কাঁকড়া আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সেগুলো রাজধানীতে পাঠাতেন। রপ্তানিকারকরা সেগুলো নিজেদের মতো করে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলো শুধু চাষ করা কাঁকড়াও রপ্তানি হচ্ছে। সারাদেশে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ কাঁকড়া চাষ ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মিঠা ও লবণাক্ত পানি মিলে মোট ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় শিলা কাঁকড়া। এটির ওজন সর্বোচ্চ সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত এই শিলা কাঁকড়া তার জীবদ্দশায় ১৪-১৬ বার খোলস বদল করে থাকে। খোলস বদল করার সময় তিন ঘণ্টার বেশি সময় এটির দেহ খোলসহীন অবস্থায় পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। তখন এটিকে রপ্তানির জন্য তুলে ফেলা হয়। নরম এই কাঁকড়াকেই বলা হয় সফ্টশেল কাঁকড়া। সফ্টশেল কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পরপরই দেখতে হয় যে কাঁকড়া খোলস পাল্টেছে কিনা। তাই এই কাঁকড়া চাষের সঙ্গে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও এর আশপাশের অনেক নারী জড়িত। তাদের শ্রম পুরুষদের তুলনায় সস্তা হওয়ার কারণে এই শিল্পে তাদের অংশগ্রহণ বেশি।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশ থেকে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছিল। এর মধ্যে শক্ত খোলসের কাঁকড়াও রয়েছে। শক্ত খোলসের কাঁকড়ার প্রধান বাজার চীন। সেখানে এই কাঁকড়া জীবন্ত রপ্তানি করা হয়। সাতক্ষীরায় প্রতিদিন পুরুষ কাঁকড়া ৫০০ গ্রাম ওজনের হলে ১৪০০ টাকা করে কেজি বিক্রি হয়। আর স্ত্রী কাঁকড়া ২০০ গ্রাম ওজনের হলেই সেটি ১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এর চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়া গড়ে ৮০০-৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। মেয়ে কাঁকড়া বড় হয়ে ডিম হলে আমরা বিক্রি করি, ওইটার দাম বেশি হয়।
চিংড়ির চেয়ে বেশি লাভজনক হওয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ও কয়রা, বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা, বাগেরহাট সদর ও শরণখোলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি কালীগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলায় কাঁকড়া চাষ বেড়েছে। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় কাঁকড়া উৎপাদন বেশি হয়।