শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ্লেষণ

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংকট :সমাধান আসবে না পাঁচ কারণে

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা
যাযাদি ডেস্ক
  ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
কাসেম সোলাইমানি হত্যাকান্ডের পর তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ

ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার ঘটনা পুরাদস্তুর একটি যুদ্ধে রূপ নেয়নি। সে হিসাবে পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে বলা যেতে পারে। কিন্তু দু'টি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো যেসব কারণ রয়েছে, সেসব কোনোটিই পরিবর্তন হয়নি। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

সাময়িক উত্তেজনা প্রশমন

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই উত্তেজনা প্রশমনকে পুরোপুরি হ্রাস বা কমে যাওয়া বলা যাবে না। ইরানের নেতারা- যারা জেনারেল সোলাইমানি হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছিলেন, তারা পালটা হামলা করার জন্য যা করার সেটা করেছেন। ইরান চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে জবাব দিতে। সুতরাং নিজেদের ভূখন্ড থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে সেই জবাব দিয়েছে। কিন্তু তাদের এই পদক্ষেপের বাস্তব এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা খুব দ্রম্নত কিছু একটা করতে চেয়েছিল, পুরাদস্তুর একটি যুদ্ধ শুরু করতে চায়নি। সুতরাং এই অধ্যায় এখনো শেষ হয়নি।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত করার ঘটনাটি নিজে থেকে স্বীকার করে নেওয়াকে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য ইরানের আরেকটি পদক্ষেপ বলে যে মনে করা হয়, সেটাও ভুল। ইরানের প্রথমে এই ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু যখন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, তাদের কাছে বিপরীত গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, ইউক্রেনের তদন্তকারীরা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নমুনা দেখতে পান, যখন স্বাধীন তদন্তকারীরা বেশ কিছু ভিডিও দেখতে পান যে, বিমানটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে, তখন ইরানের সামনে বিষয়টি স্বীকার করে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

ইরান যখন খুব তাড়াতাড়ি বুলডোজার দিয়ে বিধ্বস্ত বিমানের টুকরাগুলোকে পরিষ্কার করতে শুরু করে, তখনই স্পষ্ট হয়, তেহরান জানত আসলে কী ঘটেছে। সেটা না হলে দুর্ঘটনাস্থলের কোনো কিছুই ইরান স্পর্শ করত না। ইরানের এই স্বীকার করে নেওয়ার পেছনে দেশটির অভ্যন্তরীণ সমস্যারও অবদান রয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই দেশটিতে দুর্নীতি আর ভেঙে পড়া অর্থনীতির কারণে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। এরপরে দেখা যাচ্ছে, কত দ্রম্নত আবার বিক্ষোভ দানা বেধে উঠেছে। সুতরাং এটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমন নয়, বরং ঘরে বিক্ষোভ কমানোর একটা চেষ্টা।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পালটাচ্ছে না

যুক্তরাষ্ট্র কেন কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করল এবং ইরানের আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ইয়েমেনে হত্যার চেষ্টা চালাল? দেশটি দাবি করেছে- হয়তো আইনি কারণে; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে হামলা ঠেকাতে আত্মরক্ষা হিসেবে তারা ওই হামলা করেছে। তবে এই যুক্তিতে সন্তুষ্ট নন অনেক বিশ্লেষক অথবা ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্টের অনেক সমালোচক। ইরান যাতে বাড়াবাড়ি না করে, সেজন্য একটি পরিষ্কার সীমা বেঁধে দেয়ার জন্যই সম্ভবত এই হামলা।

সাময়িকভাবে এটি কাজ করতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যৎ কর্মকান্ড চালানোর সময় ইরান খুব সতর্কভাবে এগোবে। তবে একই সময়ে যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী পদক্ষেপ নেওয়ারও হুমকি দিচ্ছেন। আবার তিনি এই ইঙ্গিতও দিচ্ছেন যে, তিনি এখনো মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনতে চান। তিনি এটাকে অন্য কারও সমস্যা হিসেবে মনে করেন। এর ফলে শক্ত বার্তা দেওয়ার বিষয়টি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

ইরানের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা তেহরানকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে পারেনি। বরং উল্টো ইরান নিজস্ব ধরনের একটি চাপ প্রয়োগ কৌশল বেছে নিয়েছে। একদিকে তেহরানের ওপর দ্বিগুণ চাপ দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, আবার ওই এলাকা থেকে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু এই দু'টি জিনিস একই সঙ্গে পাওয়া সম্ভব নয়।

ইরানের কৌশলগত লক্ষ্য একই রয়েছে

ইরানের অর্থনীতি হয়তো ভেঙে পড়ছে এবং দেশটির অনেক বাসিন্দা অখুশি, কিন্তু সেখানে রয়েছে এক 'বিপস্নবী শাসন ব্যবস্থা'। তারা হঠাৎ করেই ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। ইরানের ইসলামিক রেভু্যলিউশনারি গার্ডের মতো বাহিনী অনেক শক্তিশালী। তাদের জবাব হচ্ছে, শক্ত হাতে দেশের ভেতর নিয়ন্ত্রণ রাখা, আর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের জবাবে পালটা চাপ দেওয়া। সেটা অব্যাহতই থাকবে।

তেহরানের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা, অন্তত পক্ষে ইরাক থেকে। অন্তত ইরানের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, তেহরানের নীতি অনেক ক্ষেত্রেই সফল। তারা সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারকে রক্ষা করতে পেরেছে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছে। ইরাকে তাদের বেশ ভালো প্রভাব রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির বৈপরীত্যের কারণে ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা নিজেদের এখন অনেক বেশি একা বলে মনে করছে।

ইরানের সঙ্গে নিম্ন পর্যায়ে আলোচনার পথ খতিয়ে দেখছে সৌদি আরব, তুরস্ক নিজেদের পথে হাঁটছে আর রাশিয়ার সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করছে। শুধু ইসরাইল মনে করে, সোলাইমানি হত্যাকান্ড ওই এলাকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে সম্পৃক্ততার পথ তৈরি করেছে। কিন্তু হয়তো তাদের হতাশ হতে হবে। অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ এবং অবনতি হতে থাকা অর্থনীতি ইরানের রেভু্যলিউশনারি গার্ডকে কোণঠাসা করে ফেলতে পারে। তারা দু'টি বড় ধরনের হামলার শিকার হয়েছে, ফলে তারা প্রতিশোধের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠতে পারে।

ইরাকের অবস্থান নিয়ে বৈপরীত্য

ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দেশটির অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার নিজেরাই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভে ভুগছে। দেশটির অনেক বাসিন্দাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি আর তাদের ওপর ইরানের প্রভাব নিয়ে অসন্তুষ্ট। দেশটির পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছে, যেখানে দেশটি থেকে মার্কিন সেনাদের চলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, মার্কিন সেনারা কালকেই তাদের বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু তাদের সেখানে রাখতে হলে বেশ কৌশলী কূটনীতির দরকার হবে।

তার বদলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলে মার্কিন ব্যাংকে থাকা ইরাক সরকারের তহবিল জব্দ করা হবে। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ত থাকা না থাকার গুরুত্ব রয়েছে। যখন তাদের বাহিনী এবং মিত্ররা ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) যোদ্ধাদের বিতাড়িত করেছিল, তখন তারা দীর্ঘদিন সেখানে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছিল। আইএসের 'খিলাফত' ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মার্কিন বাহিনী সেখানে দীর্ঘদিন থাকবে বলেই ধরে নেয়া হয়। যদি মার্কিন বাহিনীকে চলেই যেতে হয়, তখন কথিত ইসলামিক স্টেটকে ঠেকিয়ে রাখা অনেক কঠিন হবে। পাশাপাশি সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবশিষ্ট থাকা সেনাও ঝুঁকির মুখে পড়বে। কারণ এই সেনারা প্রধানত ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিগুলো থেকে সহায়তা পেয়ে থাকে। কিন্তু সেনা উপস্থিতির এই বিতর্কে যদি যুক্তরাষ্ট্র হারে, তাহলে হয়তো জয় হবে ইরানেরই।

পরমাণু শান্তি চুক্তি সত্যিকারের বিপদে

বর্তমান এই সংকটের গোড়ায় যেতে হলে ফিরে যেতে হবে ২০১৮ সালের মে মাসে, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে ইরানের অর্থনীতির ওপর সর্বোচ্চ চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র এবং সেটা চাপ এড়াতে পরমাণু চুক্তির বেশ কিছু শর্ত লঙ্ঘনের মাধ্যমে নিজেদের মতো করে পালটা চাপের কৌশল নিয়েছে ইরান। চুক্তিটি যদি পুরোপুরি বাতিল না হয়েও যায়, তখন এটা টিকে থাকবে শুধু এই কারণে যে, ট্রাম্প ছাড়া আর কেউ চুক্তিটাকে বাতিল হয়েছে বলে দেখতে চান না। অন্য কোনো পরিবর্তন না হলে চুক্তিটি শেষ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এই চুক্তিটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি হওয়ার আগে ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কারণ ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর হামলার সম্ভাবনা ছিল ইসরাইলের। চুক্তির অন্য পক্ষগুলোকে যতদিন সম্ভব নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করবে ইরান। কিন্তু যে পচন ধরেছে, তা শুধু বাড়তেই থাকবে। ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে ইউরোপীয় উদ্যোগ ছাড়া সমাধানের কোনো পথ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

পর্যায়ক্রমে চুক্তিটি যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে ইরান হয়তো ক্রমেই বোমা তৈরির দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু চুক্তিটির ক্ষেত্রে যাই ঘটুক না কেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে আরও সম্পৃক্ত করছে, যখন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা নীতি সেখান থেকে নিজেদের বের করে আনার কথা বলছে। সংবাদসূত্র: বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84975 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1