শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
বিবিসির বিশ্লেষণ

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা 'সফল না হলেও ফেলবে প্রভাব'

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা 'সফল না হলেও ফেলবে প্রভাব'
ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা বিরোধী বিক্ষোভ -ইন্টারনেট

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো জোরজবরদস্তি ছাড়াই গাজা দখলে নেওয়ার যে খোয়াব দেখছেন, তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে তা সত্ত্বেও এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন। তার মতে, ট্রাম্প তার পরিকল্পনায় গাজাকে 'মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরাতে' পরিণত করার আকাঙ্‌ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। চাইছেন সেখানকার ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসন করতে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে আরব দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন, তারা ইতোমধ্যেই পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুসারে, গাজার বাসিন্দাদের জর্ডান ও মিশরে সরিয়ে নেওয়া হবে, আর এতে আর্থিক সহায়তা দেবে সৌদি আরব। এরই মধ্যে দেশ তিনটি গাজাবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছে। শুধু তাই-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের অনেক পশ্চিমা মিত্রও এর বিরুদ্ধে।

এদিকে গাজাবাসী ফিলিস্তিনিরাও বলছে, তারা নিজ ভূখন্ড ছাড়বে না। হয়তো কেউ কেউ রাজি হবে। ধরা যাক ১০ লাখ ছাড়ল, তাও আরও ১২ লাখ মানুষ গাজায় থেকে যাবে। এর অর্থ, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ট্রাম্পকে বলপ্রয়োগ করতে হবে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হস্তক্ষেপের কথা মনে থাকলে এ ধরনের যে কোনো পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই তুমুল অজনপ্রিয়তা পাবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের নতুন এ পরিকল্পনা দুই-রাষ্ট্র সমাধানের আশায় শেষ পেরেক ঠুকবে। এই দুই-রাষ্ট্র নীতিতে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা শতাব্দী পুরনো সংঘাতের স্থায়ী অবসান ঘটাবে বলে আশা। ৯০-এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল অংশও এই দুই-রাষ্ট্র নীতি। কিন্তু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার এই সমাধানের বিপক্ষে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা আন্তর্জাতিক আইনও লঙ্ঘন করবে; যুক্তরাষ্ট্র যে 'নিয়মতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার' পক্ষে দৃঢ়, সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়বে। ইউক্রেনের একাংশ নিয়ে রাশিয়া, তাইওয়ান নিয়ে চীনের দাবিও পোক্ত হবে। তিনি এখন রিয়েলিটি টিভি হোস্ট কিংবা সংবাদে স্থান করে নিতে চাওয়া রাজনীতিক নন, বরং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট। তার এই অদ্ভূত ঘোষণা গাজার ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতিকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। যেমনটা মনে করছে ঊর্ধ্বতন এক আরব সূত্র; তারা বিবিসিকে বলেছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা গাজা যুদ্ধবিরতির 'মৃতু্যঘণ্টা' হতে পারে। গাজা ভবিষ্যতে কার হাতে শাসিত হবে তার সুস্পষ্ট উলেস্নখ না থাকাকে আগে থেকেই যুদ্ধবিরতি চুক্তির দুর্বল দিক হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছিল। এখন ট্রাম্প আরেকটা নতুন দৃশ্যকল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন। যদি এটি বাস্তবায়িত নাও হয়, তাও তা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মনে গেঁথে থাকবে। এটি কট্টর জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের স্বপ্ন ও পরিকল্পনাকেও উসকে দেবে, যারা ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত, হয়তো এর বাইরের অংশকেও, তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তা-প্রদত্ত ভূখন্ড বলে মনে করে। তাদের নেতারা নেতানিয়াহুর সরকারের অংশীদার, নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায়ও রেখেছে তারা। এই নেতারা উচ্ছ্বসিত। তারা চাইছেন গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি গড়ে তুলতে প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হোক। ইসরা্‌ইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মট্রিচ যেমন বলছিলেন, ট্রাম্প গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।

"যারা আমাদের ভূমিতে ভয়াবহ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, তারা চিরকালের জন্য নিজেদের ভূমি হারাবে। সৃুিষ্ট কর্তার সাহায্য নিয়ে এখন আমাদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনাকে চূড়ান্তভাবে কবর দিতে হবে," বলেছেন ইসরাইলি এই মন্ত্রী। মধ্যপন্থি বিরোধী নেতারা অবশ্য তুলনামূলক কম উচ্ছ্বসিত, সম্ভবত তারা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অস্থিরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা এই পরিকল্পনাকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন।

এদিকে হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনেরও মনে হতে পারে, সামরিক উপায়ে বা অন্য কোনো উপায়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার। অনেক ফিলিস্তিনিরই আশঙ্কা, ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাত তাদেরকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচু্যত করবে, যে কারণে তাদের মনে বারবার ১৯৪৮ সালের 'আল-নাকবা' বিপর্যয়ের কথা ফিরে আসছে।

সেবার সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে ইসরাইলি বাহিনী জোর করে বাস্তুচু্যত করে। তাদের অধিকাংশই আর কখনোই নিজের দখলকৃত ভূমি ফিরে পাননি। যারা ফিরেছেন, তাদের ভূমিও যখন তখন নিয়ে নেওয়ার আইন করে রেখেছে তেল আবিব। এবারও, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক ফিলিস্তিনি অবশ্য এখনই বিশ্বাস করেন যে গাজা ধ্বংস এবং এর বাসিন্দাদের বিতাড়িত করতেই ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ট্রাম্প তাদের বিশ্বাসকে দৃঢ করছেন। তার গাজা নিয়ে বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতি নেই, বরং তিনি যেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় দরকষাকষির প্রথম চাল খেললেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে