বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
সব দাবিই এক : মন্দির ভেঙে মসজিদ

ভারতে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক

উত্তরপ্রদেশের বদায়ুতে অবস্থিত শামসি মসজিদ, টিলেওয়ালি মসজিদকে কেন্দ্র করে একই বিতর্ক বেধেছে, মামলাও দায়ের করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। মন্দির-মসজিদ বিবাদের কেন্দ্রে থাকা টিলেওয়ালি মসজিদ লক্ষ্নৌয়ে অবস্থিত। পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশের কামাল মওলা মসজিদও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আদিনা মসজিদ সম্পর্কেও একই দাবি তোলা হয়েছে। হিন্দু পক্ষের মতে, মন্দির ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে এসব মসজিদ...
যাযাদি ডেস্ক
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ভারতে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক
ভারতের উত্তরপ্রদেশের সম্ভলের শাহী জামা মসজিদ

ভারতের অযোধ্যায় যখন রাম জন্মভূমি আন্দোলন তুঙ্গে, সেই সময় একটা সেস্নাগান শোনা যেত- 'অযোধ্যা তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়।' বাংলায় এর তর্জমা করলে দাঁড়ায়, 'অযোধ্যা তো শুরু মাত্র, এখনো কাশী-মথুরা বাকি আছে।' যে বিষয়ের দিকে এই সেস্নাগানের ইঙ্গিত ছিল, তা হলো- অযোধ্যা ইসু্যর নিষ্পত্তি হওয়ার পর কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদের জায়গায় একসময় মন্দির ছিল- এই দাবি তোলা।

অযোধ্যায় রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল ২০১৯ সালে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কমপক্ষে ১২টি ধর্মীয় স্থান এবং স্মৃতিসৌধ ঘিরে একই ধরনের মামলা দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি মামলায় হিন্দুপক্ষের যুক্তি এবং দাবি একই। সেখানে মূলত বলা হয়, প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ওই মসজিদ, দরগাহ বা স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছিল মন্দির ধ্বংস করে। এখন তা হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। এই দাবির স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণ জোগাড় করার জন্য জরিপের আবেদনও জানানো হয়। অন্যদিকে, মুসলিম পক্ষের তরফে সব দাবি খারিজ করে পাল্টা যুক্তি দিয়ে সাধারণত বলা হয়, এই ধরনের মামলা ১৯৯১ সালের উপাসনালয় আইনের পরিপন্থি।

কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিবাদ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। মন্দির-মসজিদ বিতর্কের আওতায় থাকা সেই তালিকায় এখন নাম জুড়েছে ৫০০ বছরের পুরনো সম্ভলের শাহী জামা মসজিদ এবং আজমিরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহেরও। সম্ভলের জামা মসজিদে দ্বিতীয়দিনের জরিপের সময় সহিংসতার ঘটনায় মৃতু্যও হয়েছে অন্তত চারজনের। খবরের শিরোনামে রয়েছে এই ঘটনা।

উলেস্নখ্য, সুপ্রিম কোর্টে সম্ভলের শাহী জামা মসজিদ মামলার শুনানি চলাকালীন মুসলিম পক্ষের সিনিয়র অ্যাডভোকেট হুজেফা আহমাদিও আদালতকে জানিয়েছিলেন, ভারতে কমপক্ষে ১০টি এই একই জাতীয় বিবাদ রয়েছে।

জ্ঞানবাপী মসজিদ

উত্তরপ্রদেশের বারানসির জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে মামলা ১৯৯১ সাল থেকে চলছে, কিন্তু ২০২১ সালে নতুন মামলা হওয়ার পর এর গতিতে দ্রম্নততা আসে। মন্দির-মসজিদ সংক্রান্ত যে কয়টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে এই মামলাটি।

বিশ্বেশ্বরের ভক্তরা এই মসজিদ নিয়ে ১৯৯১ সালে একটি মামলা দায়ের করেন। তারপর ২০২১ সালে, পাঁচজন নারী আরও একটি পিটিশন দায়ের করে যে জায়গায় মসজিদ রয়েছে সেখানে উপাসনা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। তাদের আবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছিল যে, ওই মসজিদে মা শৃঙ্গার গৌরী, গণেশ এবং হনুমানের মতো আরও অনেক দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে যা রক্ষা করা উচিত। আবেদনকারীদের দাবি, মুঘল শাসক আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। এই মামলায় দুটি সমীক্ষা করা হয়েছে; একটি আদালতের পক্ষ থেকে এবং অন্যটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইনডিয়ার তরফে।

বারানসির জেলা আদালতের রায়ের পর ২০২৪ সালের ফেব্রম্নয়ারি থেকে মসজিদের একটি বেসমেন্টে পূজাও শুরু হয়েছে। এর আগে, ২০২৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানিয়েছিল, এই পিটিশনগুলো উপাসনাস্থল আইনের বিরুদ্ধে নয়। এই সংক্রান্ত একাধিক মামলা এখনো আদালতের বিচারাধীন।

শাহী ঈদগাহ

উত্তরপ্রদেশের মথুরায় শাহী ঈদগাহ নিয়েও বিতর্ক দেখা গিয়েছে। কেউ দাবি করেন মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদটি ভগবান কৃষ্ণের জন্মস্থানে নির্মিত। ২০২০ সালে, ছয়জন ভক্ত আইনজীবী রঞ্জনা অগ্নিহোত্রীর মাধ্যমে মসজিদটি অপসারণের জন্য আবেদন জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানিয়েছিল, এই পিটিশনগুলোও ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইনের বিরুদ্ধে যায় না। ২০২৩ সালে, হাইকোর্ট একজন কোর্ট কমিশনার নিয়োগ করেছিলেন সমীক্ষার উদ্দেশে। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট এর ওপর অন্তর্র্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যা এখনো কার্যকর রয়েছে। এই মামলার পরবর্তী শুনানি ভারতের শীর্ষ আদালতে চলতি বছরের ডিসেম্বরে হওয়ার কথা রয়েছে।

জামা মসজিদ ও শেখ সেলিম চিশতি দরগাহ

আগ্রা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফতেপুর সিক্রি। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল জামা মসজিদ। সেখানে সুফি সাধক সেলিম চিস্তির দরগাহও রয়েছে। চলতি বছরে আইনজীবী অজয় প্রতাপ সিং আগ্রার একটি আদালতে এই দরগাহ নিয়ে মামলা করেন। সেই মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, এই দরগাহ ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি হলেও তার আগে সেখানে একটি মন্দির ছিল। কামাক্ষ্যা দেবীর মন্দিরের ওপর সেলিম চিশতির দরগাহ নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি করেন প্রতাপ।

এর আগে আগ্রা আদালতে আরও একটি মামলা করেছিলেন তিনি। সেই সময় আদালতে দায়ের হওয়া মামলায় অজয় প্রতাপ সিং বলেছিলেন, আগ্রার জামা মসজিদের নিচে কাটরা কেশব দেবের মূর্তি রয়েছে। তার দাবি ছিল, মসজিদ ও দরগাহের জায়গাটি হিন্দুদের দিয়ে দেওয়া হোক। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করেছে উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড, দরগাহ ও মসজিদ পরিচালনা কমিটি। তাদের এই মামলার একটি পক্ষ করা হয়েছে।

আটালা মসজিদ

এই মামলাটিও উত্তরপ্রদেশের। এই রাজ্যের জৌনপুরের আবেদনকারীদের দাবি, আটালা মাতার মন্দির ভেঙে আটালা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। আটালা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল ১৪০৮ সালে। চলতি বছরে 'স্বরাজ বাহিনী' নামে একটি হিন্দু সংগঠন তাদের আবেদনে দাবি করে, ফিরোজ শাহ তুঘলক হিন্দু মন্দির ভেঙে এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এই আবেদনের বিরোধিতা করেছে উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। গত অক্টোবর মাসে জৌনপুরের একটি দেওয়ানি আদালত তার নির্দেশে জানায়, কাশী ও মথুরায় মন্দির-মসজিদ মামলার মতোই আটালা মসজিদ সংক্রান্ত মামলার শুনানিও করা যেতে পারে।

কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ

দিলিস্নর বিখ্যাত কুতুব মিনারে অবস্থিত কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। আইনজীবী বিষ্ণুশঙ্কর জৈনের দায়ের করা আবেদনে বলা হয়েছে, একাধিক হিন্দু মন্দির ভেঙে ভেতরে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। তিনি সেখানে হিন্দুদের উপাসনা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। ২০২১ সালে সিভিল কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে জানিয়েছিল- অতীতের ভুলগুলো বর্তমান এবং ভবিষ্যতের শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করা হয় যা এখনো বিচারাধীন।

জুম্মা মসজিদ

কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরুস্থিত জুম্মা মসজিদও নিয়ে বিতর্ক চলছে গত কয়েক বছর ধরে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক সদস্যের দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে কর্ণাটকের একটি আদালত ২০২২ সালে বলেছিল যে, উপাসনাস্থল সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তরফে দাবি করা হয়েছে, মসজিদের নিচে একটি মন্দির রয়েছে। তাদের দাবি জোরালো করতে তারা মসজিদের পরিসরে জরিপের আর্জি জানিয়েছে। মামলাটি বর্তমানে ম্যাঙ্গালুরু জেলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

শাহী জামা মসজিদ

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সম্ভলের শাহী জামা মসজিদ। আইনজীবী বিষ্ণুশঙ্কর জৈন ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে একটি আবেদনে জানিয়েছিলেন, ভগবান কল্কির অবতার শ্রী হরিহর মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছিল সম্ভলের এই জামা মসজিদ। এরপর আদালত একজন কমিশনারকে নিয়োগ করে। তার নেতৃত্বেই জরিপ চালানো হয়। দ্বিতীয় দিনের সমীক্ষার সময় এই জরিপের বিরোধিতা জানিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখানো হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ বাধে এবং ঘটনাটি ক্রমে সহিংস আকার নেয়। সুপ্রিম কোর্টে সম্ভল সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন। ২৯ নভেম্বর শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, সমীক্ষা পরবর্তী রিপোর্ট সিল করে রাখতে হবে এবং হাইকোর্টের অনুমতি ছাড়া এই মামলায় আর কিছু করা যাবে না।

আজমির শরিফ দরগাহ

রাজস্থানের আজমির শহরে সুফি সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির দরগাহ নিয়ে আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেছেন 'হিন্দু সেনা' নামে একটি সংগঠনের সভাপতি বিষ্ণু গুপ্তা। তার দাবি, দরগাহের নিচে একটি শিব মন্দির রয়েছে। বিষ্ণু গুপ্তা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইনডিয়ার কাছে সমীক্ষা চালানোর দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি দরগাহের জায়গায় মন্দিরটির পুনর্র্নির্মাণ করা উচিত বলেও আবেদনে উলেস্নখ করেছেন।

এসব ছাড়াও এই সংক্রান্ত একাধিক মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুতে অবস্থিত শামসি মসজিদ। উত্তরপ্রদেশের টিলেওয়ালি মসজিদ। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে একই বিতর্ক বেধেছে, মামলাও দায়ের করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। মন্দির-মসজিদ বিবাদের কেন্দ্রে থাকা টিলেওয়ালি মসজিদ লক্ষ্নৌয়ে অবস্থিত। পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশের কামাল মওলা মসজিদও রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আদিনা মসজিদ সম্পর্কেও একই দাবি তোলা হয়েছে। হিন্দু পক্ষের মতে, মন্দির ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে ওই মসজিদ। মধ্যপ্রদেশের বিজামন্ডল মসজিদ নিয়েও বেশ কিছুদিন ধরেই একই ধরনের বিবাদ চলছে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইনডিয়া জানিয়েছিল, সেটি (বিজামন্ডল মসজিদ) একটি মসজিদ। এর বিরোধিতা করে তখন সেখানকার এক আইনজীবী চলতি বছরের আগস্টে তাদের একটি আইনি নোটিশ পাঠান। তার দাবি, এটি একটি মন্দিরই।

বিষ্ণুশঙ্কর জৈন, যিনি বেশ কয়েকটি মসজিদ-মন্দির সংক্রান্ত মামলার সঙ্গে জড়িত, তার আগের বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে অতীতে ভেঙে ফেলা সব মন্দির পুনর্র্নির্মাণের জন্য মামলা করাই তার লক্ষ্য। একই সুর শোনা গিয়েছিল আজমির শরিফ নিয়ে আদালতে মামলাকারী বিষ্ণু গুপ্তার কথায়। তিনি বলেছিলেন, তার পরবর্তী পিটিশন হবে দিলিস্নর জামা মসজিদের বিরুদ্ধে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে