হায়াত তাহরির আল-শাম নামে জিহাদি বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর অধিকাংশ স্থান দখল করার পর শনিবার সিরিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শহরটির বিমানবন্দর ও এর আশপাশের কয়েকটি শহরও দখল করে নিয়েছে। বিদ্রোহীরা আলেপ্পো শহরে প্রবেশ করেছে, যা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের জন্য বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা 'সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস' একথা জানিয়েছে। এদিকে, শনিবার (৩০ নভেম্বর) রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে সমর্থন করতে তাদের বিমানবাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তথ্যসূত্র : এএফপি, রয়টার্স
দামেস্কের মিত্র মস্কো ২০১৬ সালে আলেপ্পোতে প্রথম বিমান হামলা চালানোর পর থেকে সরকারের পক্ষে সেখানে মোতায়েন রয়েছে। এদিকে, জিহাদিরা ও তাদের তুর্কি-সমর্থিত মিত্ররা প্রতিবেশী লেবাননে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুধবার সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু করেছে।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩২৭ জন নিহত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই জিহাদি যোদ্ধা। তবে নিহতদের মধ্যে ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাটি আরও জানায়, হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং এর সহযোগী দলগুলো বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই শহরটির বেশিরভাগ এলাকা, সরকারি কেন্দ্র ও কারাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সংস্থাটি আরও জানায়, শহর থেকে সরকারি বাহিনী প্রত্যাহার করার পর, তারা আলেপ্পো বিমানবন্দরও দখল করে এবং 'কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই বেশ কয়েকটি কৌশলগত শহর' নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। কিছু বিদ্রোহী যোদ্ধা শহরের কেন্দ্রে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিজয় উদযাপন করে। সেখানে একটি ট্রাফিক লাইটে একটি বিদ্রোহী পতাকা ঝুলতে দেখা গেছে।
সিরিয়ার সেনাবাহিনী বলেছে, বিদ্রোহীরা 'আলেপ্পো ও ইদলিব ফ্রন্টে একাধিক অক্ষ থেকে ব্যাপক আক্রমণ' শুরু করেছে। অবজারভেটরি বলেছে, চতুর্থ দিনের মতো সংঘর্ষ চলাকালে সরকার ১০০ সেনা ও সরকার সমর্থক মিলিশিয়ানকে হারিয়েছে আর বিদ্রোহীদের ১৮৩ জন নিহত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, বিদ্রোহীরা মারেত আল-নুমান ও খান শেখুনসহ উত্তর জুড়ে কয়েক ডজন শহর দখল করেছে।
বিদ্রোহী যোদ্ধা মোহাম্মাদ হাম্মাদি আলেপ্পোর একটি চত্বরে 'এএফপি'কে বলেছেন, 'আমরা বছরের পর বছর ধরে এটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।' ২৯ বছর বয়সি এই যুবক আরও বলেন, 'আলস্নাহর ইচ্ছায় (ইনশাআলস্নাহ) আমরা পুরো সিরিয়া পরিষ্কার করতে যাচ্ছি।' উলেস্নখ্য, আলেপ্পোর পশ্চিম অঞ্চলগুলো ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সরকারপন্থি রেডিও স্টেশন 'শাম এফএম' জানিয়েছে, 'আলেপ্পোর বেশ কয়েকটি রাস্তায় ও পাড়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিত ছিল।' এতে আরও বলা হয়, 'বেশিরভাগ বেসামরিক মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যাচ্ছে না। তবে শহরের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ।' অবজারভেটরি বলেছে, 'আলেপ্পোর গভর্নর, পুলিশ ও নিরাপত্তা শাখার কমান্ডারদের শহরের কেন্দ্র থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।'
অবজারভেটরি জানায়, বিদ্রোহীদের অগ্রগতির মুখে আলেপ্পোর প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামা থেকেও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের উদ্ধৃত একটি সামরিক সূত্র সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার বিষয়টি অস্বীকার করে জোর দিয়ে বলেছে, সেনা ইউনিটগুলো এখনো বিদ্রোহীদের আগ্রাসনের মুখে তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
সিরীয় সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে, বিদ্রোহীরা প্রায় ২০ লাখ মানুষের শহরের 'বড় একটি অংশে' প্রবেশ করেছে। সেনাবাহিনী বলেছে, বিদ্রোহীদের হামলায় 'আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক ডজন লোক নিহত ও অন্যরা আহত হয়েছে।'
এইচটিএস হলো আল-কায়েদার সাবেক সিরিয়া শাখার নেতৃত্বে একটি জিহাদি জোট- যা তাদের মিত্রদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে উত্তর-পশ্চিমের ইদলিব অঞ্চলে একটি বিদ্রোহী ছিটমহল নিয়ন্ত্রণ করেছে।
অবজারভেটরির প্রধান রামি আবদেল রহমান বলেছেন, 'এই মুহূর্তে সিরিয়ার সরকারকে তার প্রধান মিত্র ইরান ও রাশিয়া পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে মস্কো এখন পর্যন্ত প্রতীকী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।' অবজারভেটরি জানায়, রাশিয়া শনিবার রাতে আলেপ্পোর কিছু অংশে বিমান হামলা চালায়। পরে শনিবার নতুন করে হামলায় 'কমপক্ষে ১৬ বেসামরিক লোক নিহত ও আরও ২০ জন আহত' হয়েছে। এদিকে, বিদ্রোহী যোদ্ধারা বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় সময় রোববার বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে।
ফ্রান্স বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আমেরিকা জানায়, মস্কো ও তেহরানের ওপর বাশার আল-আসাদের নির্ভরতা আলেপ্পো হারানোর পথ তৈরি করেছে। মার্কিন 'ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে'র মুখপাত্র শন স্যাভেট শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, সিরিয়ার 'রাশিয়া ও ইরানের ওপর নির্ভরশীলতা' এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক বর্ণিত ২০১৫ সালের শান্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে এগিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে 'এখন সিরিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে'।