মধ্যপ্রাচ্য সংকট
লেবাননে ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল আমেরিকার
প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহ'র মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল আমেরিকা। এতদিন কূটনৈতিক সমাধানের কথাই বলে এসেছে দেশটি। এমনকি সপ্তাহ দুয়েক আগেও একই আহ্বান জানিয়েছিল আমেরিকা ও ফ্রান্স। তবে এবার আর যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা নয়, একেবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে ওয়াশিংটন, যেটিকে একই সঙ্গে 'বাস্তবসম্মত' ও 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, আমেরিকা ও ফ্রান্স লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করতে অবিলম্বে ২১ দিনের একটি যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছিল। ইসরায়েলের হাতে হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরুলস্নাহর মৃতু্য, ১ অক্টোবর দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি স্থল অভিযানের সূচনা ও ইসরায়েলি বিমান হামলার ইরানপন্থি গোষ্ঠীটির একাধিক নেতা নিহত হলে এই প্রচেষ্টাটি বেগ হারিয়ে ফেলে।
এখন মার্কিন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে- এমন যুক্তি দেখিয়ে তাদের যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'আমরা হিজবুলস্নাহর সামরিক সক্ষমতা কমাতে ইসরায়েলের এই আক্রমণকে সমর্থন করি, যাতে শেষ পর্যন্ত আমরা একটি কূটনৈতিক সমাধানে যেতে পারি।'
মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত প্রশমন এবং হিজবুলস্নাহকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার মতো দুটি পরস্পরবিরোধী লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আমেরিকা। নতুন এই কৌশল বাস্তবসম্মত হলেও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আমেরিকা ও ইসরায়েল উভয়ের শত্রম্ন হিজবুলস্নাহ। গোষ্ঠীটির পরাজয়ে উভয়ই উপকৃত হবে। তেহরান এই গোষ্ঠীটিকে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হুমকির জন্য ব্যবহার করে থাকে। তবে ইসরায়েলের বিস্তৃত সামরিক অভিযানকে উৎসাহিত করা একটি অনিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা জন অল্টারম্যান বলেছেন, আমেরিকা হিজবুলস্নাহকে দুর্বল হিসেবে দেখতে চায়। তবে লেবাননে 'শূন্যতা সৃষ্টি' বা আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকির মতো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি বলেন, ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি এমন মনে হচ্ছে, আপনি যদি ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে না পারেন, তাহলে এটিকে গঠনমূলক উপায়ে পরিচালনা করার চেষ্টা করতে পারেন।
হিজবুলস্নাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বশেষ লড়াই শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন দক্ষিণ ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস আকস্মিক হামলা করে। এর জেরে গাজায় একটি যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। হিজবুলস্নাহ ও ইসরায়েল তখন থেকেই গুলি বিনিময় করছে।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলমান পরোক্ষ এই সংঘাত সেপ্টেম্বরে যুদ্ধে রূপ নেয়। হিজবুলস্নাহর ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল। হিজবুলস্নাহ'র ওপর পেজার হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে গোষ্ঠীটির হাজার হাজার সদস্য আহত হন।
হাসান নাসরুলস্নাহর মৃতু্যকে 'ন্যায়বিচারের একটি পরিমাপ' বলে অভিহিত করেছিল আমেরিকা। তার মৃতু্যর পরই ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে আবারও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর মধ্যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই লেবানন স্থল হামলা শুরু করেছিল। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মার্কিন যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল ইসরায়েল।
সাবেক মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য আলোচক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে সংযত করার চেয়ে এই অভিযানের সম্ভাব্য সুবিধা দেখেছিল। আর বর্তমানে কোনো অর্থপূর্ণ যুদ্ধবিরতি আলোচনা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত ইউরোপীয় সূত্র। সূত্রটি আরও জানান, ইসরায়েলিরা লেবাননে তাদের অভিযান 'মাস না হোক সপ্তাহের জন্য' হলেও চালিয়ে যাবে।
আমেরিকার জন্য ইসরায়েলি অভিযান অন্তত দুটি সুবিধা নিয়ে আসতে পারে। প্রথমত, ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী 'প্রক্সি' গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহকে দুর্বল করা, যা এই অঞ্চলে তেহরানের প্রভাবকে রোধ করতে পারে এবং ইসরায়েল ও মার্কিন বাহিনীর প্রতি হুমকি কমাতে পারে। ওয়াশিংটন আরও বিশ্বাস করে, সামরিক চাপের কারণে হিজবুলস্নাহকে আত্মসমপর্ণে বাধ্য করতে পারে এবং লেবাননে একটি নতুন সরকার নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে পারে, যা শক্তিশালী সশস্ত্র এই গোষ্ঠীকে ক্ষমতাচু্যত করবে। কয়েক দশক ধরে লেবাননে বেশ প্রভাব খাটিয়ে আসছে গোষ্ঠীটি।
পেন্টাগনের এক সাবেক কর্মকর্তা জনাথন লর্ড বলেন, এটি অর্জন করা কঠিন হবে। জনাথন এখন ওয়াশিংটনে 'নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি সেন্টারে' কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, 'একদিকে, লেবাননের অনেক মানুষ লেবাননে হিজবুলস্নাহর উপস্থিতি নিয়ে বিরক্ত। তবে একই সঙ্গে এই পরিবর্তনটি লেবাননের ওপর অত্যন্ত চরমপন্থি প্রচারণার মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।' তথ্যসূত্র : রয়টার্স