শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

কারও চোখে ছিলেন কট্টর জঙ্গি কেউ ভাবত দুর্দান্ত কৌশলী

ইয়াহিয়া সিনওয়ার
যাযাদি ডেস্ক
  ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
নিহত হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার

ইসরায়েলিদের কাছে 'শয়তানের মুখ' এবং 'খান ইউনিসের কসাই'সহ এমন নানা নেতিবাচক পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গাজা যুদ্ধে ইহুদি 'রাষ্ট্রটির' অন্যতম লক্ষ্যই ছিলেন তিনি। গত বুধবার গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত হন সিনওয়ার। কে এই ইয়াহিয়া সিনওয়ার, কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন হামাসের শীর্ষ নেতা?

সিনওয়ারকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস যোদ্ধাদের হামলার পর থেকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে জুলাইয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে তার পূর্বসূরি ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন হামাসের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা। এর আগে থেকেই অবশ্য তিনি ছিলেন হামাসের সব গুরুত্ব অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে হামাসে যোগ দেন। তিনি হামাসের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা নিরাপত্তা শাখা 'মাজদ' প্রতিষ্ঠা করেন। ইসরায়েলিদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য সন্দেহভাজন কারও ওপর কঠোর হাতে দমনের জন্য পরিচিত ছিলেন এই সিনওয়ার।

কেউ কেউ তাকে বাস্তববাদী রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও বিবেচনা করতেন। ২০১৭ সালে হামাস সিনওয়ারকে গাজায় তার প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিভাগ পলিটবু্যরোর রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেছিল।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সিনওয়ারের পরিবারের বাসস্থান ছিল মাজদাল আসকালানে। পরে ইসরায়েল যার নাম দেয় 'আসকেলন'। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের ভোটাভুটির মাধ্যমে ইসরায়েলের সৃষ্টি হওয়ার পর সিনওয়ারের পরিবারকে মাজদাল আসকালান ছেড়ে গাজার খান ইউনিসে চলে যেতে হয়। সেখানেই ১৯৬২ সালে জন্ম নেন সিনওয়ার।

সিনওয়ার ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে দখলদারিত্ব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ায় তাকে আটক করা হয়েছিল।

১৯৮৫ সালে হামাস গঠিত হওয়ার আগে মুসলিম তরুণদের নিয়ে 'মাজদ' নামে একটি দল গড়ে তোলায় তার হাত ছিল। যেসব ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে গোপনে কাজ করত, তাদের পরিচয় ফাঁস করত এই দলটি। পরে 'মাজদ' নামে দলটি হামাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে একই নামে একীভূত হয়।

সিনওয়ার তার জীবনের ২২ বছর ইসরায়েলের কারাগারে ছিলেন। ১৯৮৮ সালে দুই ইসরায়েলি সেনাকে জিম্মি এবং তাদের হত্যা করায় সিনওয়ারকে আটক করা হয়েছিল। ২০১১ সালে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পান তিনি। এরপর ২০১২ সালে সিনওয়ার হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোতে নির্বাচিত হন, যেখানে তিনি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালে তিনি হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডের নেতৃত্ব পান। কেউ কেউ সিনওয়ারকে 'কট্টরপন্থি জঙ্গি' হিসেবে দেখলেও অন্যরা তাকে একজন 'দক্ষ কৌশলবিদ' হিসেবে দেখেছেন।

কারাদন্ডের ১৫ বছর পর হিব্রম্ন ভাষার ওপর নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি জনগণকে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেব না, কিন্তু আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিতে প্রস্তুত, এতে ওই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।'

২০১৮ সালে সিনওয়ারের নেতৃত্বে হামাস তার 'মার্চ অব রিটার্ন' প্রচার শুরু করেছিল। তখন গাজাবাসী প্রতি সপ্তাহেই ইসরায়েল সীমান্তের কাছে বিক্ষোভ দেখাত। এই বিক্ষোভের ফলে হামাস আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনও কুড়াতে সক্ষম হয়েছিল। দলটির রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সিনওয়ার বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে আঞ্চলিক আরব শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছিলেন। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) গবেষণা অনুসারে, মিসরীয় নেতাদের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং ইরান থেকে অব্যাহত সামরিক তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে সিনওয়ারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ইসরায়েল প্রকাশ্যে সিনওয়ারকে গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার পেছনের 'মাস্টারমাইন্ড' বলে অভিযুক্ত করেছে। ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ওই হামলায় হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা করে, যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। তখন প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা নিয়ে গিয়েছিল যোদ্ধারা। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনার সময় সিনওয়ারকে একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং সম্ভবত গাজায় যোগাযোগের মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। জিম্মিমুক্তির আলোচনায় ইসরায়েল, হামাস, আমেরিকা, কাতার ও মিসরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন। এক বছর ধরে চলা যুদ্ধের পুরোটা সময়ই সিনওয়ার হামাসের নেতৃত্বকে সুসংহত করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষ করে মোহাম্মদ দেইফ নামে পরিচিত আল-কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ আল-মাসরি ও তার ডেপুটি মারওয়ান ইসার মৃতু্যর পর তার প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ।

২০১৫ সালে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিনওয়ারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীর তকমা দেয়। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স তার ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছিল। সব মিলিয়ে হামাসের এই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যাকে বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখছে ইসরায়েল। তথ্যসূত্র : সিএনএন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে