মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১
মধ্যপ্রাচ্য সংকট

নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ

ইসরায়েলের দীর্ঘসময়ের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ২০ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন যে, উপেক্ষা করলেও, কীভাবে আমেরিকার চাপ সামলানো যায়। নেতানিয়াহু জানেন যে, আমেরিকা; বিশেষ করে তাদের বর্তমান নির্বাচনের বছরে তাকে তার পথ থেকে সরাতে চাপ দেবে না এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে, তিনি আমেরিকার শত্রম্নর বিরুদ্ধেও লড়ছেন... চলতি বছর এপ্রিলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক কম্পাউন্ডে বোমা হামলার নির্দেশ দেন, যেখানে নিহতদের মধ্যে দুজন ইরানি জেনারেলও ছিলেন। এরপর জুলাইয়ে বৈরুতে বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুলস্নাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর হত্যার অনুমোদন দেন তিনি। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাতে হতভম্ব হয়েছিলেন বলে বব উডওয়ার্ডের নতুন এক বইয়ে দাবি করা হয়েছে। এখানে হতভম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সংঘাত বাড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, যা হোয়াইট হাউস কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিল...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন

লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান দ্বিতীয় সপ্তাহ পার হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসন দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলার পর যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হয়েছে। তবে এই হামলা শুক্রবারও অব্যাহত ছিল। তাতে লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় আহত হয়েছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী।

সংঘাত অবসানের আহ্বান সত্ত্বেও ইসরায়েল নতুন করে হামলা শুরু করেছে গাজার জাবালিয়ায়। ইসরায়েলের সহযোগীরা গত সপ্তাহের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছে। যদিও সব চাপ উপেক্ষা করে ইসরায়েল তার নিজের পথেই চলছে এবং এর কারণ হলো তিনটি : ৭ অক্টোবর, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং আমেরিকা।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে দামেস্ক থেকে রাতের একটি ফ্লাইটে বাগদাদে গিয়েছিলেন ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তিনি ইরানের এলিট বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন। এটি মূলত ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের গোপন ইউনিট। এই গ্রম্নপটির নামের অর্থ জেরুজালেম এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসরায়েল। ইরাকে, লেবাননে, ফিলিস্তিনি ভূখন্ড ও অন্যত্র অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ ও সরাসরি ছায়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে তারা। ওই সময় সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনির পর ইরানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মানুষ।

সোলাইমানির গাড়িবহর বিমানবন্দর ছাড়া মাত্রই ড্রোন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে তিনি নিহত হন। যদিও ইসরায়েল তার প্রতিপক্ষের অবস্থান চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে, তারপরও ড্রোনটি ছিল আমেরিকার। ওই হত্যাকান্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন আমেরিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নন।

পরে এক বক্তৃতায় সোলাইমানি হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি কখনোই ভুলবেন না যে, নেতানিয়াহু তাদের হতাশ করেছিলেন। আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ওই ঘটনায় তিনি ইসরায়েলের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিলেন এবং অভিযোগ করেছিলেন যে, নেতানিয়াহু চাইছিলেন যে 'আমেরিকা তার শেষ সেনা পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই করুক'।

নেতানিয়াহু ওই হত্যাকান্ডের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ওই সময় এটা মনে করা হতো যে, তার উদ্বেগ ছিল এই যে, ইসরায়েল সরাসরি জড়িত হলেও এটা সরাসরি ইরান কিংবা লেবানন ও ফিলিস্তিন থেকে ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলার কারণ হতে পারে।

ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে জড়িত ছিল। কিন্তু উভয়পক্ষই সতর্ক ছিল, যাতে তাদের লড়াই একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। বড় সংঘাতে জড়িত পড়ার উসকানি হতে পারে- এমন ভয় থেকেই এটা হতো।

চার বছর পর চলতি বছর এপ্রিলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক কম্পাউন্ডে বোমা হামলার নির্দেশ দেন, যেখানে নিহতদের মধ্যে দুজন ইরানি জেনারেলও ছিলেন। এরপর জুলাইয়ে বৈরুতে বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুলস্নাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর হত্যার অনুমোদন দেন তিনি। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাতে হতভম্ব হয়েছিলেন বলে বব উডওয়ার্ডের নতুন এক বইয়ে দাবি করা হয়েছে। এখানে হতভম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সংঘাত বাড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যা হোয়াইট হাউস কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিল।

বব উডওয়ার্ড লিখেছেন, 'ইসরায়েল সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে ধারণা তৈরি হচ্ছে, তা হলো- 'তুমি একটা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র, একজন দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়'। একই প্রধানমন্ত্রীকে আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্ট চিহ্নিত করলেন 'অত্যন্ত সতর্ক' হিসেবে আর তার উত্তরসূরি চিহ্নিত করলেন আগ্রাসী হিসেবে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন এবং একটি রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিপর্যয়কর দিন। এই দুটি বিষয়ই ইসরায়েলকে চলমান যুদ্ধে জড়িত হতে সহায়তা করে।

ইসরায়েলে হামাসের হামলার মাত্রা ও ব্যাপকতা ইসরায়েলি সমাজ এবং এর নিরাপত্তাবোধের ওপর প্রভাব ফেলেছে, যে কারণে এবারের যুদ্ধ সাম্প্রতিক সব সংঘাতের চেয়ে আলাদা।

মার্কিন প্রশাসন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে ইসরায়েলকে। আবার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃতু্য ও গাজার দুর্ভোগ তাদের জন্য অস্বস্তির ও রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর।

এপ্রিলে ইসরায়েলে ইরানের হামলা ঠেকাতে আমেরিকার বিমানও সক্রিয় ছিল। এটি একটি পরিষ্কার প্রমাণ যে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ে তার সবচেয়ে বড় সহযোগী কতটা ভূমিকা রাখে।

চলতি গ্রীষ্মে আমেরিকার পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই ইসরায়েল হিজবুলস্নাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইসরায়েলের দীর্ঘসময়ের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ২০ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন যে, উপেক্ষা করলেও, কীভাবে আমেরিকার চাপ সামলানো যায়। নেতানিয়াহু জানেন যে, আমেরিকা; বিশেষ করে তাদের বর্তমান নির্বাচনের বছরে তাকে তার পথ থেকে সরাতে চাপ দেবে না এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে, তিনি আমেরিকার শত্রম্নর বিরুদ্ধেও লড়ছেন।

ভিন্ন হিসাব

এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, নেতানিয়াহু ইসরায়েলের রাজনৈতিক মূলধারার বাইরে গিয়ে কাজ করছেন। সেজন্য হিজবুলস্নাহর ওপর শক্ত আঘাত হানার চাপ বাড়তে পারে, এমনকি ইরানের বিরুদ্ধেও।

গত মাসে আমেরিকা ও ফ্রান্স যখন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল তখন ইসরায়েলের বিরোধ ও প্রধান বাম ও ডান ধারা থেকে ২১ দিনের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরোধিতার সমালোচনা এলো। ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর কারণ শুধু এটা নয় যে, তারা আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় সক্ষম, বরং ৭ অক্টোবরের পর নিজের হুমকিগুলোর প্রতি সহনশীলতার নীতি পাল্টে গেছে।

হিজবুলস্নাহ দীর্ঘকাল ধরেই ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের গালিলিতে হামলা করতে চাইছে। এখন ইসরায়েলের মানুষের ঘরে বন্দুকধারীর হামলার অভিজ্ঞতা হলো। সে কারণে তারা মনে করলে এই হুমকি উপড়ে ফেলতে হবে।

ঝুঁকি বিষয়ে ইসরায়েলের ধারণাও পাল্টে গেছে। ওই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সামরিক সীমারেখা হারিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যা সর্বাত্মক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে তেহরান, বৈরুতে, তেল আবিব ও জেরুজালেমে বৃষ্টির মতো বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।

ইসরায়েল হামাস প্রধানকে হত্যা করেছে, যখন তিনি তেহরানে ইরানের অতিথি ছিলেন। তারা হিজবুলস্নাহর প্রধান হাসান নাসরুলস্নাহসহ পুরো নেতৃত্বকে ধ্বংস করেছে। সিরিয়ায় কূটনৈতিক ভবনে দুজন ইরানি কর্মকর্তাকেও হত্যা করেছে।

হিজবুলস্নাহ ৯ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন ছুড়েছে ইসরায়েলের শহরগুলো লক্ষ্য করে। তেল আবিবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতিরাও বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে।

ইরানও গত ছয় মাসে দুইবার হামলা করেছে, যাতে পাঁচশর বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছে। এবং এর কোনো একটিই হয়তো ওই অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে এবং সত্যি হলো- ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও এসব বিষয়ে কোনো ঝুঁকি না নিয়েই তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে