গত ১ অক্টোবর ইরানের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরায়েলের প্রায় অনিবার্য প্রতিশোধের ঘড়ি বাজছে। হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরুলস্নাহকে হত্যা আর তার আগে হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ইরান এই হামলা চালিয়েছে। তারা দুজনই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত গত বুধবার (৯ অক্টোবর) দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, যখন ইসরায়েল এর প্রতিশোধ নেবে, তখন তা হবে 'সুনির্দিষ্ট ও প্রাণঘাতী' এবং ইরান এর জন্য প্রস্তুতও থাকবে না।
আবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল যে কোনো ধরনের হামলা চালালে তেহরানের পাল্টা হামলা অনেক বেশি শক্তিশালী ও ভয়ংকর হবে। তিনি শুক্রবার রাতে ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল 'টিজি৩- এ সম্প্রচারিত একটি টকশো অনুষ্ঠানে ওই হুঁশিয়ারি দেন। ইরানের গত ১ অক্টোবরের ইসরায়েলবিরোধী হামলার জবাবে তেহরানে পাল্টা হামলা চালাতে ওয়াশিংটন তেল আবিবকে সবুজ সংকেত দিয়েছে কিনা বা সে রকম হামলা হলে ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে আরাকচি ওই হুঁশিয়ারি দেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটি নতুন কোনো বিষয় নয় যে, ইসরায়েল মার্কিন সরকারের সবুজ সংকেত পাচ্ছে। কাজেই ওটি নিয়ে তেহরানের কোনো মাথাব্যথা নেই, তবে যে কোনো ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এটি পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র। তিনি বলেন, ওই অভিযান বিনা কারণে চালানো হয়নি বরং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে ৮০ বছরের ইসরাইলি বর্বরতা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
পাশাপাশি ইরান উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করেছে, যেন তাদের আকাশসীমা কোনো ধরনের হামলার জন্য ব্যবহার না হয়। এদের মধ্যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি আরও বলেছে, যে দেশই ইরানে আক্রমণ চালাতে ইসরাইলকে সহায়তা করবে, সেটি ইরানের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত হবে।
এগুলো এখন বিবেচনায় নেওয়ার কিছু কারণ হচ্ছে, ইসরায়েলের পরিকল্পিত আক্রমণ কী রূপ নেবে, তা নিয়ে চলছে আমেরিকা ও ইসরায়েলের আলোচনা। প্রকাশ্যেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর যে কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
চার সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে তেলের স্থাপনায় হামলা চালিয়ে পাম্পে দাম বাড়ানোর বিষয়টিকে হোয়াইট হাউস যেমন সাধুবাদ জানাবে না, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যকে আরেকটি যুদ্ধের দিকেও টেনে নিতে চাইবে না।
তাহলে এরপর কী হবে?
ইসরায়েলের মিত্ররা গত এপ্রিলে অচলাবস্থার সময় যে সংযমের আহ্বান জানিয়েছিল, তা এবার আরও নিস্তেজ হয়ে গেছে। এদিকে, লেবানন, গাজা, ইয়েমেন এবং সিরিয়ায়- একযোগে ইসরায়েলের সব শত্রম্নদের মোকাবিলা করার দৃঢ় সংকল্পের কারণে নেতানিয়াহু সরকার পিছিয়ে আসার মানসিকতায় নেই বলে মনে হচ্ছে।
মার্কিন স্যাটেলাইটের গোয়েন্দা তথ্য এবং ইরানের মাটিতে মোসাদের (ইসরায়েলের বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা) মানব এজেন্টদের সহায়তায় ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কাছে বেছে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু লক্ষ্য রয়েছে। এগুলোকে মোটামুটিভাবে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
এক. প্রচলিত সামরিক কায়দায়- প্রাথমিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্য হবে ঘাঁটি, যেখান থেকে ইরান সেই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উৎক্ষেপণ করেছে। এর অর্থ হলো লঞ্চ প্যাড, কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার, রিফুয়েলিং ট্যাংক এবং স্টোরেজ বাঙ্কার। আরও এক ধাপ এগিয়ে আইআরজিসির ঘাঁটিগুলোর পাশাপাশি বিমান প্রতিরক্ষা এবং অন্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারিগুলোতে আঘাত করতে পারে। এমনকি এটি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার চেষ্টাও করতে পারে।
দুই. অর্থনৈতিক- এতে ইরানের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ অন্তর্ভুক্ত হবে- এর পেট্রোকেমিক্যাল পস্ন্যান্ট, বিদু্যৎ উৎপাদন এবং সম্ভবত এর পরিবহণ সংক্রান্ত স্বার্থ। তবে এটি অজনপ্রিয় একটি পদক্ষেপ হবে। কারণ এটি সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণের তুলনায় সাধারণ মানুষের জীবনকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
তিন. পারমাণবিক- ইসরায়েলের জন্য বড় একটি ক্ষেত্রে এটি। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএর মাধ্যমে এটি একটি জানা বিষয় যে, বেসামরিক পারমাণবিক শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ২০ শতাংশের চেয়েও বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে ইরান। ইসরায়েল এবং অন্যরা সন্দেহ করে যে, ইরান 'ব্রেকআউট পয়েন্টে' পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, যেখানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশটি একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হবে। ইসরায়েলের সম্ভাব্য টার্গেট তালিকার মধ্যে রয়েছে পারচিন, ইরানের সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল, তেহরানের গবেষণা চুলিস্ন, বনাব এবং রামসার। এছাড়াও আছে বুশেহর, নাতাঞ্জ, ইসফাহান এবং ফেরদোর প্রধান স্থাপনা। তাদের হিসাব-নিকাশের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকবে ইরানের প্রতিক্রিয়া অনুমান করার চেষ্টা এবং তা কীভাবে প্রশমিত করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করা।
গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলি সামরিক লক্ষ্যবস্তু বলে দাবি করা স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর ইরান মনে করছে এখন হিসাব সমান হয়েছে। তবে ইসরায়েল প্রতিশোধ নিলে পাল্টা আঘাত হানবে বলে সতর্ক করেছে ইরান। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, 'এটি আমাদের সক্ষমতার একটি আভাস মাত্র।' এই বার্তাটিকে আরও শক্তিশালী করতে আইআরজিসি বলেছে, 'যদি ইহুদিবাদী শাসক ইরানের কার্যক্রমে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে এটি নিষ্ঠুর আক্রমণের সম্মুখীন হবে।'
ইরান সামরিকভাবে ইসরায়েলকে পরাজিত করতে পারবে না। এর বিমান বাহিনী পুরনো এবং জরাজীর্ণ, আকাশ প্রতিরক্ষা ছিদ্রযুক্ত এবং দেশটিকে বছরের পর বছর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু এখনো ইরানের হাতে প্রচুর পরিমাণে ব্যালিস্টিক এবং অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি বিস্ফোরক ভর্তি ড্রোন ও মধ্যপ্রাচ্যের চারপাশে বহু মিত্র স্থানীয় মিলিশিয়া রয়েছে। তাদের পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটির পরিবর্তে বেসামরিক এলাকাগুলো লক্ষ্য করতে পারে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনার ওপর ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ার হামলা দেখিয়েছিল যে, এর প্রতিবেশীরা আক্রমণের কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পারস্য উপসাগরে ইরানের আইআরজিসি নৌ-বাহিনীর ছোট এবং দ্রম্নত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সক্ষম বড় নৌ-বহর প্রস্তুত রয়েছে যা আমেরিকার পঞ্চম নৌ-বহরের যুদ্ধজাহাজের প্রতিবক্ষা ব্যবস্থাকে সংঘবদ্ধ আক্রমণে ব্যর্থ করতে সক্ষম। নির্দেশ দেওয়া হলে এগুলো হরমুজ প্রণালিতে মাইন স্থাপন করে বিশ্ব তেলের দৈনিক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। এর পাশাপাশি, উপসাগরের আরব দিকের কুয়েত থেকে ওমান পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোও রয়েছে।
ইরান সতর্ক করে দিয়েছে যে, যদি তাদের ওপর হামলা করা হয়, তাহলে তারা কেবল ইসরায়েলের ওপরই আঘাত হানবে না বরং আক্রমণকে সমর্থন করা যে কোনো দেশকে তাদেরও লক্ষ্যবস্তু বানাবে। এগুলোই কিছু সম্ভাব্য পরিস্থিতি, যা এখন তেল আবিব এবং ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকারীরা বিবেচনা করছেন। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ