লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুলস্নাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত গত কয়েক বছর না হলেও কয়েক মাস ধরে বাড়ছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান আগ্রাসনে এটি আরও বেড়ে গেছে। একসময় যা ধারণা করা হচ্ছিল, এখন সেটিই বাস্তব হয়ে উঠেছে। সেটি হলো- হিজবুলস্নাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। এটা কম বেদনার বিষয় নয়।
গত কয়েকদিনে হিজবুলস্নাহ ও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহিংসতা বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। লেবাননের দক্ষিণে ও রাজধানী বৈরুতের অংশবিশেষে ইসরায়েল অতিসম্প্রতি যে বিমান হামলা শুরু করেছে, তার কয়েক দিন আগেই এক গুপ্তহত্যা পরিকল্পনা কার্যকর করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। পরিকল্পনামতো হিজবুলস্নাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকি-টকির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করে বেশ কয়েকজনকে। তাতে আহত হন আরও কয়েক হাজার মানুষ। এর পর ঘটল দুই পক্ষের মধ্যে বিমান হামলা ও প্রতিশোধমূলক রকেট ছোড়ার ঘটনা।
লেবাননের দক্ষিণ থেকে লোকজনকে সরে যাওয়া, নইলে ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হওয়ার হুমকি দেওয়ার পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল কয়েক বছরের মধ্যে লেবাননে আকাশপথে সবচেয়ে বড় অভিযান শুরু করেছে। এরই মধ্যে দুই হাজারের বেশি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। অধিকাংশ হামলা চালানো হচ্ছে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে। হামলায় ইসরায়েল তার বিমান বাহিনীর বড় শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে।
এই হামলা শুরুর চার দিন পর হিজবুলস্নাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুলস্নাহ সংগঠনটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারসহ নিহত হন। রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে এক বৈঠক করার সময় তাকে লক্ষ্য করে ৮৫ বাংকারবিধ্বংসী বোমা ফেলে ইসরায়েল। এতে কয়েকটি ভবন মাটিতে মিশে যায়।
বড় রকমের এ ধাক্কা সত্ত্বেও বিভিন্ন ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে চলেছে হিজবুলস্নাহ। ইসরায়েল যে সংকটের সম্মুখীন, এই বিমান হামলা চালিয়ে তা নিরসন করা যাবে না। এখনকার এ বাস্তব দৃশ্যের জন্য হিজবুলস্নাহ অনেক বছর ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বেসরকারি সশস্ত্র সংগঠনটি লেবাননজুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে নিজস্ব রকেটশক্তিকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, হিজবুলস্নাহর পরিকল্পনা কী?
সম্ভাব্য কয়েকটি দৃশ্য
ইসরায়েল লড়াইয়ে তার সুদক্ষ বিমান সেনাদের দেশটির উত্তরে মোতায়েন করেছে। একই সঙ্গে সক্রিয় করেছে নর্দান কমান্ডের রিজার্ভ সেনাদের। এর অর্থ ইসরায়েলের এ বার্তা পাঠানো যে, হিজবুলস্নাহকে মোকাবিলা করার বিষয়কে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে তারা। কিন্তু ইসরায়েলের এ রণসজ্জা কি বাস্তবসম্মত? লড়াইয়ে তারা জিতবে কি? হিজবুলস্নাহকেই বা কি তারা নিঃশেষ করতে পারবে? জবাব হলো- ইসরায়েলের সমরসজ্জা বাস্তবসম্মত নয়। আর তাদের জেতার বা হিজবুলস্নাহকে নির্মূল করার সম্ভাবনাও অনেকটা নেই। হিজবুলস্নাহ লেবাননের সমাজের সঙ্গে মিশে আছে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণে শিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে। হিজবুলস্নাহর সঙ্গে লড়াই সংগঠনটিকে শুধু আরও শক্তিশালীই করবে, কেননা এটিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ধারণা অবাস্তব।
২০০৬ সালে ইসরায়েল ঘোষণা করেছিল, হিজবুলস্নাহকে তারা শেষ করে দেবে। সেই বছর দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। কিন্তু ইসরায়েলের ঘোষণা বাস্তবে ফলেনি। দেশটির সেনাদের দক্ষিণ লেবানন ছেড়ে চলে যেতে হয়। যুদ্ধে হিজবুলস্নাহ জয়ী হওয়ার দাবি করে।
ওই ঘটনার এত বছর পর এখন হিজবুলস্নাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েল আবার স্থল অভিযান শুরু করল। কিন্তু এবারও তার জন্য ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। ইসরায়েলের এ কর্মকান্ডের জন্য হিজবুলস্নাহ বছরের পর বছর তাদের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ইসরায়েলের স্থল বাহিনীকে রুখতে এই যোদ্ধারা একদিকে যেমন সমন্বিত প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, অন্যদিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের।
আবার ইসরায়েলের এই অভিযান হিজবুলস্নাহ বিরোধীদের উসকানি ও লেবাননকে আবার গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে- এমন আশঙ্কা করতে পারেন কেউ কেউ। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই সম্ভাবনাও খুব একটা নেই।
এদিকে, এ অভিযান কি বাফার জোন (নিরপেক্ষ অঞ্চল) তৈরি করবে এবং হিজবুলস্নাহকে সীমান্ত থেকে দূরে সরিয়ে দেবে? এটি হতে পারে। তবে এর সম্ভাব্য চূড়ান্ত ফল বিপর্যয়কর।
বাফার অঞ্চল
নিরপেক্ষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা শুনতে ভালো লাগলেও সীমান্তে এ ধরনের যে কোনো উদ্যোগে ইসরায়েলের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনার সম্ভাবনাই খুব বেশি থাকবে। বাফার অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে তেল আবিবকে তার স্থল বাহিনীর চলাচল নিজ স্থলভাগেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। আর সংঘাত নিরপেক্ষ অঞ্চল এড়িয়ে লেবাননে ঢুকতে হলে ইসরায়েলি স্থল বাহিনীকে পার্বত্য ও পাথুরে পথ পাড়ি দেওয়ার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং ট্যাংক ও অন্যান্য সমরযানকে সড়কপথে পরিচালিত করতে হবে। এটি ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হিজবুলস্নাহর হঠাৎ আক্রমণ সহজতর করে তুলবে। হিজবুলস্নাহর যে কৌশল ২০০৬ সালে হকচকিত করে দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনীকে। অবশ্য ইসরায়েলি বাহিনী এখন অনেকটাই পরিপক্ব এবং আগের ভুল দ্বিতীয়বার করবে না তারা।
হিজবুলস্নাহও এরই মধ্যে কম শিক্ষা নেয়নি। সংগঠনটি এত বছরে তার বাহিনী আরও শক্তিশালী করেছে। ২০০৬ সালে ইসরায়েল-হিজবুলস্নাহ যুদ্ধের সময় দক্ষিণ লেবাননে সংগঠনটির যোদ্ধার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের মতো। এ সংখ্যা বর্তমানে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার। সঙ্গে রয়েছে হাজার হাজার রিজার্ভ সদস্য। হিজবুলস্নাহর বিশেষ বাহিনী 'রাদওয়ান ফোর্সে' রয়েছে তিন হাজার যোদ্ধা। তারা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েল সীমান্তে লড়াই করার বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এ অঞ্চল তাদের কাছে হাতের উল্টো পিঠের মতোই চেনা।
ইসরায়েল ও হিজবুলস্নাহ- দুই পক্ষই শত্রম্নর অবস্থান শনাক্ত করতে নানা ধরনের প্রযুক্তি, নজরদারি ড্রোন ব্যবহার করে। হিজবুলস্নাহর আছে করনেট ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ট্যাংকবিধ্বংসী অত্যাধুনিক অস্ত্রের সমৃদ্ধ ভান্ডার। ইসরায়েলের মারকাভা ট্যাংকের বিরুদ্ধে এটি তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে।
লেবাননে স্থল অভিযানের জেরে কোনো বাফার অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলেও ইসরায়েলকে সীমান্তে সেনা মোতায়েন রাখার পাশাপাশি জোরদার তলস্নাশি, নজরদারি ও বিমান বাহিনীকে কাজে লাগানোর মতো পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে। এতে দেশটির স্থল বাহিনী রাস্তায় পেতে রাখা বোমা, স্নাইপার, হঠাৎ আক্রমণ ও রকেট হামলার মতো নিরবচ্ছিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে।
তা ছাড়া বাফার অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলেও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়া বন্ধ করবে না হিজবুলস্নাহ। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কৌশলবিদরা বাফার অঞ্চলের আওতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু লেবাননের যে কোনো স্থান থেকে ইসরায়েলের একেবারে ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর যথেষ্ট সক্ষমতা হিজবুলস্নাহর রয়েছে।
বিপরীতে বাফার অঞ্চল যত বড় হবে, তত বেশি লেবাননি ইসরায়েলি দখলদারির আওতায় পড়বেন। সার্বিকভাবে এমন পদক্ষেপ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের মুখে ঠেলে দেবে, যা টেনে নেওয়ার আর্থিক সক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে কি না, সন্দেহ আছে। সব মিলিয়ে ইসরায়েলের জন্য সামনে বিপর্যয়ই অপেক্ষা করছে। তথ্যসূত্র : আল-জাজিরা