ইসরায়েলের চেয়ে সামরিক শক্তিতে তিন ধাপ এগিয়ে রয়েছে ইরান। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যের্ যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪, আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম। পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক খাতে ব্যয়, সেনা সদস্য সংখ্যা সবকিছুতেই ইসরায়েলকে টক্কর দিকে প্রস্তুত তেহরান। তবু কেন তেল আবিবের এত দাপট?
গত ১ অক্টোবর মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাতে ইসরাইলি ভূ-খন্ডে অন্তত ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলের তিনটি সামরিক ঘাঁটি ও বেশকিছু অবকাঠামো লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হয়।
ইরানের বিপস্নবী গার্ড বাহিনী 'আইআরজিসি' জানায়, গাজায় দখলদারদের চলমান হত্যাকান্ড এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুলস্নাহ প্রধান নাসরুলস্নাহর হত্যার জবাবে এই হামলা চালিয়েছে তারা। নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলে একসঙ্গে ২০০ ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালিয়ে 'মারাত্মক ভুল করেছে এবং এই জন্য তেহরানকে 'চড়া মূল্য' দিতে হবে। তিনি এই হামলার প্রতিবাদে পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন।
এক প্রতিবেদনে 'বিবিসি' জানায়, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন অনেকে। কারণ, দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। সেই তালিকায় শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪ আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম।
'গেস্নাবাল ফায়ার পাওয়ার'র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের তুলনায় ইরান তিন ধাপ এগিয়ে। এই অবস্থায় দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, একে অপরকে আক্রমণ ও নিজ ভূ-খন্ড রক্ষার সামর্থ্য কতটুকু, এসব বিষয় খতিয়ে দেখেছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম 'আল-জাজিরা'। প্রশ্ন উঠেছে ইসরায়েলের চেয়ে সামরিক শক্তিতে তিন ধাপ এগিয়ে ইরান, তবু কেন এত দাপট নেতানিয়াহু প্রশাসনের?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্যাট্রেজিক স্টাডিজ'র মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ছয় লাখ ১০ হাজার।
এর মধ্যে তিন লাখ ৫০ হাজার সেনা সদস্য, এক লাখ ৯০ হাজার বিপস্নবী গার্ড বাহিনীর সদস্য, ১৮ হাজার নৌ-সেনা, ৩৭ হাজার বিমান সেনা ও ১৫ হাজার বিমান প্রতিরক্ষা সদস্য। দেশটির রয়েছে তিন লাখ ৫০ হাজার রিজার্ভ সেনাও।
সেই তুলনায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা এক লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য এক লাখ ২৬ হাজার, নৌ-সেনা ৯ হাজার ৫০০ এবং বিমান বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৩৪ হাজার। ইসরায়েলের রয়েছে চার লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনাও। গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট'র গত এপ্রিল মাসের তথ্যমতে, ইরান ২০২৩ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১০ দশমিক তিন বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার ৩০ কোটি ডলার। ২০২২ সালের তুলনায় এটি শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ বেশি।
একই সময়ে ইসরায়েলের ব্যয় ছিল ২৭ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন, অর্থাৎ দুই হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। এটি ২০২২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু করা নজিরবিহীন হামলার কারণে দেশটির ব্যয় এক বছরে এত বেড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
'দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩' অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১০ হাজার ৫১৩টি ট্যাংক, ছয় হাজার ৭৯৮টি কামান এবং ৬৪০টির বেশি সাঁজোয়া যান। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার, বিপস্নবী গার্ড বাহিনীর রয়েছে আরও পাঁচটি। বিপরীতে ইসরাইলের রয়েছে প্রায় ৪০০ ট্যাংক, ৫৩০টি কামান ও এক হাজার ১৯০টি সাঁজোয়া যান। দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩-এর অনুযায়ী, ইরানের বিমান বাহিনীর রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান, বিপস্নবী গার্ডের রয়েছে আরও ২৩টি। বিমান বাহিনীর রয়েছে দুটি যুদ্ধ হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি এবং বিপস্নবী গার্ডের পাঁচটি। আর ইসরায়েলের রয়েছে ৩৪৫টি যুদ্ধবিমান ও ৪৩টি জঙ্গি হেলিকপ্টার।
এ ছাড়া ইরানের রয়েছে ১৭টি সাবমেরিন, ৬৮টি প্যাট্রল ও কোস্টাল কমব্যাটান্ট, সাতটি রণতরি, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট, ১৮টি লজিস্টিকস ও সাপোর্ট সরঞ্জাম। অন্যদিকে, ইসরাইলের রয়েছে পাঁচটি সাবমেরিন ও ৪৯টি প্যাট্রল ও কোস্টাল।
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত নির্ভরশীল 'আয়রন ডোম' ব্যবস্থার ওপর। ১ অক্টোবর রাতে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই আয়রন ডোম ব্যবস্থায় প্রতিহত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একেকটি আয়রন ডোম ব্যবস্থায় থাকে একটি রেডার, যা সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্য বস্তুর গতি ও লক্ষ্যস্থল শনাক্ত করে। পরে নিয়ন্ত্রণকক্ষ হিসাব-নিকাশ করে দেখে, এটি কোনো হুমকি না হলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র বা বস্তুকে ফাঁকা স্থানে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আর হুমকি মনে হলে সেটি ভূপাতিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট ইউনিট থেকে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র। ইসরাইলজুড়ে আছে ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি। আছে আরও কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যার সাহায্যেও মধ্যম ও দূরপালস্নার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানা প্রতিহত করা হয়।
এদিকে, ইরান গত ফেব্রম্নয়ারিতে স্বল্পপালস্নার 'আজারখশ' আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। এটি একটি ইনফ্রারেড শনাক্তকরণ ব্যবস্থা। সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত এবং তা প্রতিহত করতে এ ব্যবস্থায় যুক্ত আছে রেডার এবং ইলেক্ট্রো অপটিক ব্যবস্থা। এটি যানবাহনের ওপরও স্থাপন করা যায়।
ইরানের আছে বিভিন্ন পালস্নার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে ৪২টির বেশ দূরপালস্নার রাশিয়ার তৈরি এস-২০০ ও এস-৩০০ এবং ৫৯টির বেশি মাঝারি পালস্নার আমেরিকার তৈরি এমআইএম-২৩ হক, এইচকিউ-২জে ও খোরদাদ-১৪। আছে আমেরিকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'সেন্টার ফর স্ট্যাট্রেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ'র মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইরানের অস্ত্র ভান্ডারে রয়েছে অন্তত ১২ ধরনের মধ্যম ও স্বল্প পালস্নার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর একটি 'টনডার-৬৯', এর পালস্না ১৫০ কিলোমিটার। এছাড়া আছে 'খোরামশাহর' ও 'সেজিল'। এগুলোর পালস্না দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত।
অপরদিকে ইসরাইলের রয়েছে অন্তত চার ধরনের স্বল্প ও মধ্যম এবং মধ্যবর্তী পালস্নার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে 'এলওআরএ' ক্ষেপণাস্ত্রের পালস্না ২৮০ কিলোমিটার ও 'জেরিকো-৩' ক্ষেপণাস্ত্রের পালস্না চার হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার ৫০০ কিলোমিটার।
আমেরিকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন'র মতে, ইসরায়েলের আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে, ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নেই। তবে তার রয়েছে খুবই সমৃদ্ধ পরমাণু কর্মসূচি। দেশটি বেশ কিছু পরমাণু স্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র পরিচালনা করছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনি পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ২০০০ সালের শুরুতে একটি ফতোয়া দেন। তিনি বলেছিলেন, এই ধরনের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ।' অবশ্য ইসরায়েলের আগ্রাসন ও বৈশ্বিক হুমকি বিবেচনায় গত মে মাসে তেহরান তার অস্তিত্ব রক্ষায় পরমাণু কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনার হুমকি দিয়েছে। তথ্যসূত্র : এএফপি