ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের এক বছর

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছে

চলতি বছরের এপ্রিলে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ প্রথম শুরু হয়েছিল কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। পরে তা ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লস অ্যাঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আটলান্টায় বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয় এ ঘটনায়। টেক্সাসের অস্টিনে সেখানকার গভর্নর ট্রুপারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের আটক করতে। তারপরও ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন চালিয়ে গেছেন...

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন-গাড়ি -সাম্প্রতিক ছবি
ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং এর জের ধরে গাজা যুদ্ধ শুরুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত সোমবার। বছর শেষে সেই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে আর যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হয়েছে। ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণ ছিল ইসরায়েলিদের জন্য ভয়াবহ একটি দিন। প্রায় ১২০০ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক, নিহত হয়েছিলেন। ঘটনার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ফোন করে বলেছিলেন, 'আমরা আমাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে কখনো এ ধরনের বর্বরতা দেখিনি।' ইসরায়েলিরা হামাসের ওই হামলাকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। এরপর ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা চালায়, যাতে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। গাজার বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ফিলিস্তিন গণহত্যার অভিযোগ এনেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ এরপর আরও ছড়িয়েছে। হামাসের হামলার ১২ মাস পর এসে মধ্যপ্রাচ্য এখন ভয়াবহ এবং আরও ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ গত বছর ডিসেম্বরে গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। গাজায় হামাসের ব্যবহৃত ৮০০টির মতো 'সন্ত্রাসী টানেল' পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিল ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। এর মধ্যে ৫০০টি ধ্বংস করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা। আর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন 'সন্ত্রাসী লক্ষ্য বস্তুতে' প্রায় ১০ হাজারের মতো বিমান হামলা চালানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে আইডিএফ। এই যুদ্ধ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ইসরায়েলকে। হামাস ও হিজবুলস্নাহ নেতা নিহত ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া ইসরায়েলি হামলায় 'নিহত' হওয়ার কথা সংগঠনটি জানায় ৩১ জুলাই। ইরানের রাজধানী তেহরানে তার বাসস্থানে 'জায়নবাদী গুপ্ত হামলায়' এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে তারা। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। ইসমাইল আবদেল সালাম হানিয়া, যার ডাক নাম আবু আল-আবদ, জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক বু্যরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অন্যদিকে, শেখ হাসান নাসরালস্নাহ হলেন একজন শিয়া ধর্মপ্রচারক, যিনি ১৯৯২ সাল থেকে লেবাননের ইরানপন্থি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহ'র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গত ২৮ অক্টোবর ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স দাবি করেছে, বৈরুতে এক হামলায় হাসান নাসরালস্নাহকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ১ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে স্থল অভিযান শুরু করেছে বলে জানায় তাদের ডিফেন্স ফোর্স আইডিএফ। যেসব জায়গায় হামলা হচ্ছে, সেগুলো ইসরায়েলি কমিউনিটির জন্য হুমকি বলে উলেস্নখ করে তারা। ইসরায়েলে ইরানের সরাসরি হামলা গত এপ্রিলে সিরিয়ায় ইরানি কনসু্যলেটে ইসরায়েলের হামলায় কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডারের মৃতু্যর ঘটনায় ইসরায়েলে ৩০০টির বেশি ড্রোন হামলা চালিয়েছিল ইরান। ইসরায়েলের ভূখন্ড লক্ষ্য করে এটিই ছিল ইরানের প্রথম সরাসরি হামলা। সে সময় প্রায় সব ড্রোনই ভূপাতিত করেছিল ইসরায়েল, আমেরিকা এবং তাদের আরব মিত্ররা। ওই হামলায় ইসরায়েলের একটি বিমান ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জবাবে তখন ইরানের একটি বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল। এরপর চলতি মাসের শুরুতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে আবারও শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। মূলত হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহর হত্যার জেরে এই হামলা করে ইরান। হামলার পর ইসরায়েলজুড়ে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কথা জানিয়ে একটি বিবৃতিও দিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তারা বলেছে, প্রায় ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে এবং অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়েছে, তবে মধ্য এবং দক্ষিণাঞ্চলে 'কিছু আঘাতের' ঘটনাও ঘটেছে। ইরানকে এই হামলার 'পরিণাম ভোগ করতে হবে' বলেও এরপর হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। লেবাননে ব্যাপক হামলা হিজবুলস্নাহ স্থাপনা লক্ষ্য করে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গত ১ অক্টোবর হামলা শুরুর আগে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বৈরুতে শহরের তিনটি এলাকা থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন, এই হামলার কারণে অন্তত ১০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে। হিজবুলস্নাহর ডেপুটি কমান্ডার নাইম কাসেম বলেছেন, ইসরায়েলের স্থল অভিযানের জন্য তারা প্রস্তুত এবং এই যুদ্ধ 'দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে'। নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে আমেরিকার একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়েছে গত জুনে। প্রস্তাবে শর্ত হিসেবে রাখা হয়েছে 'পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরতি', হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি, মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষ ফেরত দেওয়া এবং ফিলিস্তিনি বন্দিবিনিময়। ইসরায়েল এরই মধ্যে প্রস্তাবে সম্মত আছে বলে 'রেজলু্যশনে' উলেস্নখ করা হয়। হামাসকেও রাজি হতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে এতে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি ইউরোপের তিন দেশের চলতি বছরের মে মাসে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের তিন দেশ- স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে। দেশগুলো বলেছে, তাদের এই স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হলো- মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করা। স্বীকৃতি দেওয়া তিনটি দেশ তখন বলেছিল, তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ব সীমানার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যখন জেরুজালেমকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন- উভয় দেশের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্য পদ দেওয়ার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব এই বছরের মে মাসে পাস হয়েছে সাধারণ পরিষদে। তবে এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে এখনো ভোটাভুটি হয়নি। ফিলিস্তিনের পক্ষে আমেরিকায় বিক্ষোভ চলতি বছরের এপ্রিলে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ প্রথম শুরু হয়েছিল কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। পরে তা ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লস অ্যাঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আটলান্টায় বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয় এ ঘটনায়। টেক্সাসের অস্টিনে সেখানকার গভর্নর ট্রুপারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের আটক করতে। তারপরও ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতেও দেশে দেশে বিক্ষোভ গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে ৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী লাখো ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ করেছেন। জাকার্তা থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে রাবাত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। এর আগে শনিবার আমেরিকার ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কসহ ইউরোপের বড় বড় শহরে রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। ইস্তাম্বুলে জড়ো হওয়া হাজারো বিক্ষোভকারীদের একজন আহমেত উনাল বলেছেন, 'আমরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে এখানে এসেছি।' এদিকে, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার এক বছর হওয়াকে কেন্দ্র করে প্যারিসে মিছিল করেছেন সেখানকার ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, ওই হামলায় অন্তত এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫০ জন জিম্মি হয়েছিলেন। গত রোববার বিশ্বের অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে অন্তত হাজারখানেক মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাদের দাবি ছিল, মার্কিন প্রশাসনকে অবিলম্বে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও ফিলিস্তিনপন্থি হাজারো জনতা জড়ো হয়েছিলেন। যথেষ্ট পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও সেখানে মানুষ ফিলিস্তিন ও লেবাননের পতাকা উড়িয়েছেন। এদিকে, ইসরায়েলি পতাকা ওড়ানোর কারণে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। ওই পতাকায় 'স্টার অব ডেভিড'-এর বদলে 'স্বস্তিকা' (নাৎসি বাহিনীর ব্যবহৃত প্রতীক) অঙ্কিত ছিল। গাজা ও লেবাননে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবিতে মরক্কোর রাজধানী রাবাতে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার জনতা। ইসরায়েলের সঙ্গে মরক্কোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা। তেল আবিবের সঙ্গে রাবাতের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিরোধিতা করে স্স্নোগান দেওয়া হয়, 'স্বাভাবিকীকরণকে না বলুন, ফিলিস্তিন বিক্রির জন্য নয়' (নো টু নরমালাইজেশন, প্যালেস্টাইন ইজ নট ফর সেল)। এদিকে, বিক্ষোভে ইহুদিবিদ্বেষ ও ইসলাম ভীতিসূচক পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্বব্যাপী ইহুদি ও মুসলিমদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করেছেন তারা। ইসরায়েলের 'আত্মরক্ষার অধিকারের' পক্ষে বরাবরই সাফাই গেয়ে আসছে মার্কিন প্রশাসনসহ অন্যান্য মিত্ররাষ্ট্র। কিন্তু গাজায় চলমান আগ্রাসন ও সম্প্রতি লেবাননে শুরু হওয়া অভিযান নিয়ে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ, রয়টার্স