মধ্যপ্রাচ্য সংকট
লেবাননে যতবার আক্রমণ ইসরায়েলের
ইসরায়েল এখনো গাজা অভিযানে তার প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর একটিও অর্জন করতে পারেনি। যতদূর জানা যায়, দক্ষিণ লেবাননে হিজবুলস্নাহর বিশাল টানেল নেটওয়ার্ক এবং সুবিধা রয়েছে। গাজায় প্রবেশ করার সময় তাদের সামরিক উদ্দেশ্যগুলোর একটি ছিল- হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা আর প্রায় এক বছর পরও তারা সেটা করেনি... ম মনে রাখতে হবে, হিজবুলস্নাহ হামাস নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা এখনো বেশ ভালোভাবে সশস্ত্র এবং কৌশলগতভাবে স্থাপিত। গোষ্ঠীটি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিরোধ চালাতে সক্ষম হবে। এটি ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য চড়া মানবিক এবং বস্তুগত মূল্যের হতে পারে...
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
প্রতিবেশী দেশ লেবাননে স্থল আক্রমণ শুরু করেছে ইসরায়েল। এর আগে দেশটিতে একের পর এক বোমা হামলা ও সেখানে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহকে লক্ষ্য করে অভিযান চালায় ইসরায়েল। তবে এমন আক্রমণের কোনো ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আগেরবারের ঘটনাগুলোতে মিশ্র ফল এসেছে। এবারের আক্রমণও কি আগের আক্রমণগুলোর চেয়ে ভিন্ন ফল আনতে পারে?
১৯৭৮ : প্রথম আক্রমণ
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল 'রাষ্ট্র' সৃষ্টির পর ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে লেবানন। সেই শরণার্থীদের মধ্যে পিএলও'র মতো ফিলিস্তিনি মিলিশিয়াও ছিল। এই মিলিশিয়ারা লেবানন থেকে ইসরায়েল আক্রমণ করে দেশটিকে সংঘাতের দিকে টেনে নেয়। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো লেবাননে আক্রমণ করে ইসরায়েল। তখন সমুদ্রপথে এসে একটি বাস জব্দ করে আধাসামরিক গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও)। তাতে ৩৮ জন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়, যা ইসরায়েলে 'কোস্টাল রোড গণহত্যা' নামে পরিচিত। এর জবাবেই আক্রমণ চালায় ইসরায়েল।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে যাওয়ার দুই মাস পর সেখান থেকে সরে যায়। প্রতিবেশী দেশের মধ্যেই তারা একটি 'বাফার জোন' তৈরি করে সেখানে ২০০০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে। এই আক্রমণে লেবাননে দুই হাজার যোদ্ধা ও বেসামরিক মানুষের মৃতু্য হয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলের ১৮ জন সেনা নিহত হয়।
১৯৮২: সবচেয়ে বড় আক্রমণ
ইসরায়েল দেশটিতে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য অপারেশন চালায় ১৯৮২ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময়। শত শত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানসহ হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনা সীমান্ত অতিক্রম করে। সেবারও তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পিএলওকে হটানো, যারা লেবানন থেকে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিল। ইসরায়েলিদের উদ্দেশ্য ছিল পিএলও'র অবস্থানকে লক্ষ্যবস্তু করা, যাতে তারা ইসরায়েলে আক্রমণ বন্ধ করে।
ইসরায়েলের বাহিনী একাধিক ফ্রন্টে অনুপ্রবেশ করে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী বৈরুতের উপকণ্ঠে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আক্রমণের সময় ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ওপর গণহত্যা চালায় ইসরায়েলি সেনারা। লেবাননের মধ্যে একটি 'বাফার জোন' তৈরি করে তিন মাস পর ইসরায়েলিরা ফিরে আসে। সেবারের আক্রমণে লেবাননে ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। আর ইসরায়েলের ৬৫৪ জন সেনা নিহত হয়।
১৯৯৬ : একটি নতুন শত্রম্ন ও নতুন আক্রমণ
১৯৮২ সালের আক্রমণে পিএলওকে স্থানচু্যত করতে সফল হয় ইসরায়েল। এর ফলে লেবানন থেকে তিউনিসিয়াতে সদর দপ্তর সরিয়ে নেয় তারা। এর পরে আক্রমণাত্মক আধাসামরিক গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহ গড়ে ওঠে। হিজবুলস্নাহও ইসরায়েলকে তার শত্রম্ন হিসেবে বিবেচনা করে আক্রমণের চেষ্টা করে।
হিজবুলস্নাহর রকেট হামলার জবাবে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলি বাহিনী প্রথমবারের মতো তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। হঠাৎ চালানো এই আক্রমণ মাত্র দুই সপ্তাহের একটি অপারেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এতে আবারও বেসামরিক নাগরিকরাই ক্ষতির মুখে পড়ে। লেবাননের দিক থেকে ১৩ জন হিজবুলস্নাহ যোদ্ধা ও ২৫০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হলেও ইসরায়েল কোনো মৃতু্য দেখেনি। ইসলামি গোষ্ঠীদের রকেট নিক্ষেপ আর ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর বোমা হামলার মতো বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ইসরায়েল ও হিজবুলস্নাহর মধ্যে সংঘাত থেকেই যায়।
২০০৬ : যুদ্ধের ৩৪ দিন
এরপর আসে ২০০৬ সালের জুলাই মাস। সীমান্তের ওপারে ইসরায়েলি শহরগুলোতে গোলাবর্ষণের পাশাপাশি হিজবুলস্নাহ যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে এবং দুটি সামরিক গাড়িতে হামলা চালায়। সেখানে আটজন সেনাকে হত্যা এবং দুইজনকে জিম্মি করে তারা। জবাবে লেবাননজুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা এবং আর্টিলারি ফায়ার চালায় ইসরায়েল। একইসঙ্গে বিমান ও নৌ অবরোধ করে দক্ষিণ লেবাননে স্থল আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধ ৩৪ দিন স্থায়ী হয়েছিল, যা যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়। লেবাননে প্রায় এক হাজার ১৯১ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক। আর ইসরায়েলের দিকে ১২১ জন সেনা এবং ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
সামরিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনের মতে, হিজবুলস্নাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ আপাতত দুই দেশের মধ্যকার ভারসাম্যে পরিবর্তন এনেছে। আমেরিকান ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল হিজবুলস্নাহ সংগঠনের শিরশ্ছেদ করেছে, তাদের অর্ধেক অস্ত্র ধ্বংস করেছে এবং লেবানন আক্রমণ করেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষক ইয়োভ স্টার্ন বিবিসিকে বলছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ১৯৮২ সালের মতো ব্যাপক সেনা মোতায়েনের বিপরীতে এবারও ২০০৬ সালের মতো কৌশল নিয়ে এগোবে ইসরায়েল। তিনি বলেন, 'এটি একটি ধীর, সতর্ক এবং হিসাব করা আক্রমণ হবে, যেখানে প্রধান অক্ষে দ্রম্নত ও ব্যাপক আক্রমণের পরিবর্তে দক্ষিণ লেবাননের একের পর এক শহর দখল করা হবে।'
টার্ন আরও বলেন, দক্ষিণ লেবাননের শহরগুলোতে হিজবুলস্নাহ দীর্ঘকাল ধরে অবস্থান করছে। যার ফলে ইসরায়েলের এই শহরগুলো দখল করে দ্রম্নত ছেড়ে যেতে পারার সম্ভাবনা কম। তবে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলের হামলা এবং এবারের লেবানন আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। হিজবুলস্নাহর অবকাঠামো এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সফল আক্রমণ সত্ত্বেও লেবাননের দৃশ্যপট অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং প্রমাণিত হতে পারে।
'অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি'র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আমিন সাইকাল বলেন, 'হিজবুলস্নাহ হামাস নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা এখনো বেশ ভালোভাবে সশস্ত্র এবং কৌশলগতভাবে স্থাপিত। গোষ্ঠীটি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিরোধ চালাতে সক্ষম হবে। এটি ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য চড়া মানবিক এবং বস্তুগত মূল্যের হতে পারে।
জেরেমি বোয়েন উলেস্নখ করেছেন, ইসরায়েল এখনো গাজা অভিযানে তার প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর একটিও অর্জন করতে পারেনি। তিনি বলেন, 'যতদূর জানা যায়, দক্ষিণ লেবাননে হিজবুলস্নাহর বিশাল টানেল নেটওয়ার্ক এবং সুবিধা রয়েছে। গাজায় প্রবেশ করার সময় তাদের সামরিক উদ্দেশ্যগুলোর একটি ছিল হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা আর প্রায় এক বছর পরেও তারা সেটা করেনি।'
এবার গাজায় যুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত লড়াইয়ের প্রায় এক বছর পর ইসরায়েল লেবাননে এই আক্রমণ চালিয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে বলছে, হিজবুলস্নাহর রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার কারণে বাস্তুচু্যত সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদে ফিরে আসা তারা নিশ্চিত করতে চায়।
হিজবুলস্নাহ একটি শিয়া ইসলামপন্থি সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন, যা লেবাননে উলেস্নখযোগ্য ক্ষমতার মালিক। ইসরায়েল, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশ একে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে।
আইডিএফ গত বৃহস্পতিবারও ঘোষণা করেছে যে, তাদের বিমান দক্ষিণ লেবাননে এবং অস্ত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও নজরদারি পোস্টসহ ২০০টি হিজবুলস্নাহ 'সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে' আঘাত করেছে। বিনতে জবিলের পৌরসভা ভবনে হানা আঘাতে প্রায় ১৫ জন হিজবুলস্নাহ যোদ্ধা নিহত হয়েছে বলে জানায় তারা। পরে তারা জানায় যে, বিমান ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত যৌথ অভিযানের সময় তিন হিজবুলস্নাহ কমান্ডারের একটি আবাসন কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে।
হিজবুলস্নাহ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা দিনের বেলায় কিছু সীমান্তবর্তী গ্রামে অগ্রসর হওয়ার জন্য ইসরায়েলি কমান্ডোদের 'ব্যর্থ প্রচেষ্টা প্রতিহত করেছে'। গোষ্ঠীটি আরও বলেছে, তারা সীমান্তের অন্য দিকে 'শত্রম্ন জমায়েত এবং বাড়িগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, পাশাপাশি উত্তর ইসরায়েলের ভেতরে রকেট নিক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে।
আইডিএফ বলেছে যে, সারাদিনে ইসরায়েলি ভূখন্ডে ২৩০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। বেশিরভাগই আটকানো হয়েছে বা খোলা জায়গায় পড়েছে এবং এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এখন প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? কারণ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েলের এবারের হামলাও না গাজার মতো ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ