আরবি হিজবুলস্নাহ শব্দের অর্থ 'সৃষ্টিকর্তার দল'। লেবাননের ক্ষমতার উলেস্নখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রণ এই শিয়া ইসলামপন্থি সংগঠনটির হাতে। একাধারে রাজনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে হিজবুলস্নাহ। সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে। সে সময় লেবানন ইসরায়েলের দখলদারত্বের সম্মুখীন হয়েছিল। এর আদর্শিক বীজবপন হয় আরও আগে, ষাট ও সত্তরের দশকে লেবাননে শিয়া ইসলামিক পুনর্জাগরণের দিনগুলোতে।
২০০০ সালে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করে নিলে হিজবুলস্নাহর ওপরও নিরস্ত্রীকরণের জন্য চাপ বাড়তে থাকে। তারা সেই চাপ প্রতিহত করে সামরিক শাখা 'ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স'র সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যায়। কোনো কোনো দিক থেকে লেবানিজ সেনাবাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায় তারা। যার প্রমাণ মেলে ২০০৬ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়। পর্যায়ক্রমে লেবাননের রাজনৈতিক ব্যবস্থারও গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব হয়ে ওঠে হিজবুলস্নাহ। এমনকি মন্ত্রিপরিষদে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতাও তারা বাগিয়ে নিতেও সক্ষম হয়।
ইহুদি এবং ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা ও নাশকতার অভিযোগ আছে হিজবুলস্নাহ বিরুদ্ধে। পশ্চিমা বিভিন্ন রাষ্ট্র, ইসরায়েল, আরব লিগ এবং আরব দেশগুলো তাদের 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে দেখে। কোনো কোনো লেবানিজও হিজবুলস্নাহকে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য একটা হুমকি মনে করে। কিন্তু, শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সংগঠনটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
'রেজিস্ট্যান্স'
হিজবুলস্নাহ প্রতিষ্ঠার দিন-ক্ষণ সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ লেবাননে পাল্টা আক্রমণ চালায় ইসরায়েল। সে সময় লেবাননের প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন 'আমল মুভমেন্ট' থেকে সশস্ত্র লড়াইয়ে বেশি আগ্রহী, এমন একটি অংশ বেরিয়ে যায়। 'ইসলামিক আমল' নামে নতুন একটি সংগঠন গড়ে তোলে তারা। নতুন সংগঠনটি ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের কাছ থেকে উলেস্নখযোগ্য সামরিক ও সাংগঠনিক সহায়তা পায়। ফলে তারা সবচেয়ে কার্যকরী শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যাদের হাতে পরে হিজবুলস্নাহ গঠিত হয়।
ইসলামিক আমলের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও তার মিত্র, সাউথ লেবানন আর্মির (এসএলএ) ওপর হামলা চালায়। অন্য বিদেশি শক্তিও তাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে মার্কিন দূতাবাস এবং ইউএস মেরিন ব্যারাকে বোমা হামলায় তারা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ আছে। ওই হামলাগুলোয় ২৫৮ মার্কিন এবং ৫৮ ফ্রেঞ্চ কর্মী নিহত হন। সেই ঘটনার পরম্পরায় পশ্চিমা শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৯৮৫ সালে একটি 'খোলা চিঠি' প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় হিজবুলস্নাহ। চিঠিতে আমেরিকা এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইসলামের মূল শত্রম্ন বলে চিহ্নিত করে তারা। একই সঙ্গে ইসরায়েল মুসলিমদের ভূমি দখল করে আছে বলে মন্তব্য করে দেশটিকে ধ্বংস করার ডাকও দেওয়া হয় চিঠিতে। 'জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে, মানুষের অবাধ ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামিক ব্যবস্থা গ্রহণের' আহ্বানও জানিয়েছিল সংগঠনটি।
লেবাননে গৃহযুদ্ধের অবসান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে 'তায়েফ চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নিরস্ত্রীকরণের প্রশ্নে হিজবুলস্নাহ তাদের সামরিক শাখাকে 'ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স' অর্থাৎ ইসলামিক প্রতিরোধ নামে রি-ব্র্যান্ড (নতুনভাবে রূপায়ণ) করে। ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান ঘটানোর জন্য 'ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স' নিবেদিত বলে জানানো হয়। ফলে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ না করে রেখে দেওয়ার সুযোগ পায় তারা।
১৯৯০ সালে সিরিয়ার সেনাবাহিনী লেবাননে শান্তি স্থাপনে নিয়োজিত হওয়ার পর, হিজবুলস্নাহ দক্ষিণ লেবাননে তাদের গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। একই সঙ্গে লেবানিজ রাজনীতিতেও সক্রিয় হতে শুরু করে তারা। ১৯৯২ সালে সফলভাবে জাতীয় নির্বাচনে অংশও নেয়। অবশেষে ২০০০ সালে ইসরায়েল যখন লেবানন থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়, তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হয় হিজবুলস্নাহকে। সে সময় আবারও হিজবুলস্নাহর নিরস্ত্রীকরণের প্রশ্ন উঠলেও সেই চাপ প্রতিহত করে গোষ্ঠীটি এবং দক্ষিণাঞ্চলে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখে। যুক্তি হিসেবে সেবা ফার্ম ও অন্য বিবদমান এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতিকে সামনে আনে তারা।
২০০৬ সালে সীমান্তের অপর পাশে হিজবুলস্নাহর সশস্ত্র যোদ্ধাদের আক্রমণে আট ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়, অপহৃত হয় দুজন। ওই ঘটনার তীব্র জবাব আসে ইসরায়েলের দিক থেকে। দক্ষিণ লেবানন ও বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুলস্নাহর শক্ত অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। প্রতু্যত্তরে ইসরায়েল অভিমুখে চার হাজার রকেট ছোড়ে হিজবুলস্নাহ। ৩৪ দিন ধরে চলা ওই সংঘাতে অন্তত এক হাজার ১২৫ জন লেবানিজ মারা যান, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে ইসরায়েলে ১১৯ সেনা এবং ৪৫ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরও হিজবুলস্নাহ টিকে যায় এবং পরে আরও শক্তিশালী হয়ে আবির্ভূত হয়। সেই থেকে নতুন নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ ও অস্ত্রের উৎকর্ষ ঘটিয়ে সামর্থ্য বৃদ্ধি করে চলেছে তারা।
'রাজনৈতিক দর্শন'
২০০৮ সালে লেবাননের পশ্চিমা সমর্থিত সরকার হিজবুলস্নাহর নিজস্ব টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। গোষ্ঠীটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে বৈরুত বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করে তারা। এর প্রতিক্রিয়ায় রাজধানীর অনেক অংশের দখলে নেয় হিজবুলস্নাহ। লড়াই করতে থাকে সুন্নি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে। সাম্প্রদায়িক ওই সহিংসতায় ৮১ জন নিহত হন, দেশ উপনীত হয় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। সংঘাত থামাতে সরকার নিজের অবস্থান থেকে পিছু হটে এবং হিজবুলস্নাহর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করতে সম্মত হয়। ওই চুক্তি মন্ত্রিসভার যে কোনো সিদ্ধান্তকে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দেয় হিজবুলস্নাহ ও তার মিত্রদের।
২০০৯ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টের ১০টি আসনে জিতে জোট সরকারের অংশীদার হয় গোষ্ঠীটি। ওই বছরের শেষ নাগাদ নতুন এক রাজনৈতিক ইশতেহার সামনে আনেন হিজবুলস্নাহর সেক্রেটারি জেনারেল শেখ হাসান নাসরালস্নাহ। যেটিকে সংগঠনের 'পলিটিক্যাল ভিশন' বা রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালের ইশতেহারের 'ইসলামিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার অংশটুকু বাদ পড়ে নতুন ইশতেহারে। কিন্তু আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোরাল বক্তব্য বজায় ছিল। নিজেদের অস্ত্র রাখার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয় এতে।
২০০৫ সালে গাড়িবহরে বোমা হামলায় মারা যান লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি। ২০০৯ সালে নির্বাচনে জিতে তারই ছেলে সাদ হারিরির প্রধানমন্ত্রিত্বে জোট সরকারে অংশ নেয় হিজবুলস্নাহ। কিন্তু রফিক হারিরির ওপর হামলার ঘটনায় তাদের চার সদস্যকে অভিযুক্ত করা হলে ২০১১ সালে হিজবুলস্নাহ ও তার মিত্রদের চাপের মুখে সাদ হারিরির সরকার ভেঙে যায়। হারিরি ছিলেন সৌদি আরব সমর্থিত একজন সুন্নি প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সরকারগুলোরও অংশীদার হয়ে থেকেছে হিজবুলস্নাহ ও এর মিত্ররা। যেখানে তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষণীয়।
সিরিয়ার যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করলে হিজবুলস্নাহর হাজার হাজার সদস্য প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের হয়ে লড়াই করতে যায়। বিশেষ করে লেবানিজ সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে বিদ্রোহীদের কাছে হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করে দিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে তারা। সিরিয়া ও ইরানের সঙ্গে সখ্যের কারণে প্রতিপক্ষ আরব দেশগুলোর কাছে চক্ষুশূল হয়ে ওঠে হিজবুলস্নাহ।
ইসলামিক জীবন ধারার বিস্তার হিজবুলস্নাহর অন্যতম অগ্রাধিকার। শুরুর দিকে এর নেতারা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের শহর-গ্রামে কঠোর ইসলামিক আচরণবিধি আরোপ করতেন। যদিও ওই অঞ্চলের সবার কাছে সেটি জনপ্রিয়তা পায়নি। হিজবুলস্নাহ জোর গলায় বলে, তাদের তৎপরতাকে লেবানিজদের ওপর ইসলামিক সমাজ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ