মধ্যপ্রাচ্য সংকট
ইসরাইলের হামলার পরও অক্ষত হিজবুলস্নাহর সুড়ঙ্গ-অস্ত্রাগার
হিজবুলস্নাহর প্রধান সমর্থক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী ইরান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দেশে ইরানের মিত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দল এই হিজবুলস্নাহ। তাদের অনেক অস্ত্রই ইরানি, রাশিয়ান বা চীনা মডেলের। নতুন আসা অস্ত্রগুলো সম্পর্কে বা কোথা থেকে কেনা হয়েছে, সে বিষয়েও বিস্তারিত কিছু জানাননি সূত্রগুলো... বেশ ভালোভাবেই তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে হিজবুলস্নাহ। গত রোববার দক্ষিণ লেবাননের এমন এলাকা থেকে রকেট ছোড়া হয়েছিল, যেখানে তার কিছুক্ষণ আগেই ইসরাইল হামলা চালিয়েছিল। হিজবুলস্নাহর একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার রয়েছে বলে মনে করা হয় এবং গত মাসে প্রকাশিত এক ফুটেজে দেখা যায়, হিজবুলস্নাহর যোদ্ধারা রকেট লঞ্চার নিয়ে টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রাক চালাচ্ছেন...
প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
নমনীয় কাঠামোর চেইন অব কমান্ড, বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক এবং গত এক বছরে ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্রের বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলার কারণে হিজবুলস্নাহ ইসরাইলের হামলা সামলে উঠতে পারছে। ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত তিনটি সূত্র এ তথ্য দিয়েছেন।
গত সপ্তাহে ইসরাইলের হামলায় হিজবুলস্নাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের টার্গেট করা হয় এবং পেজার ও ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণেও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। গত শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) ইসরাইলের হামলায় হিজবুলস্নাহর অভিজাত 'রাদওয়ান বাহিনী'র প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্ব দেওয়া ইব্রাহিম আকিল নিহত হন। আর গত সোমবার বৈরুতে হামলায় ৫৬০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫০ জন শিশু ও ৯৪ জন নারী ছিল বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর প্রধান হার্জি হালেভি দাবি করেছেন, আকিলের মৃতু্য হিজবুলস্নাহকে নাড়া দিয়েছে। তার দাবি, হামলায় হিজবুলস্নাহর হাজার হাজার রকেট ও শেল ধ্বংস হয়েছে।
তবে হিজবুলস্নাহর কর্মকান্ডের সঙ্গে পরিচিত দুটি সূত্র বলেছেন, গোষ্ঠীটি দ্রম্নতই হামলায় নিহত আকিল এবং অন্য জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের দায়িত্ব প্রতিস্থাপন করেছে। হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহ ১ আগস্টের একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, যখনই কোনো নেতাকে হত্যা করা হয়, তখন দলটি দ্রম্নত তার শূন্যস্থান পূরণ করে।
হিজবুলস্নাহর এক কর্মকর্তা 'রয়টার্স'কে বলেছেন, যোগাযোগ ডিভাইস বিস্ফোরণে দেড় হাজার যোদ্ধা আহত হয়েছেন। তাদের অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছেন বা তাদের হাত উড়ে গেছে।
এটি একটি বড় ধাক্কা হলেও হিজবুলস্নাহর শক্তির একটি ভগ্নাংশই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুক্রবার মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিবেদনে গোষ্ঠীটির যোদ্ধার সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজারের মতো বলে উলেস্নখ করা হলেও নাসরালস্নাহর দাবি, দলটির এক লাখ যোদ্ধা রয়েছেন।
গত বছরের অক্টোবর থেকে মিত্র হামাসের সমর্থনে ইসরাইলে নানা সময় ছোট আকারে হামলা করেছে হিজবুলস্নাহ। তিনটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, তখন থেকে দক্ষিণের ফ্রন্টলাইন এলাকায় হিজবুলস্নাহ যোদ্ধাদের আবার মোতায়েন করেছে। এসব যোদ্ধার অনেকে সিরিয়া থেকেও এসেছেন।
সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চাইলেও, পরবর্তী সময়ে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের আভাস পেয়ে হিজবুলস্নাহ লেবাননে দ্রম্নতগতিতে অনেক রকেট জড়ো করেছে বলেও জানিয়েছে রয়টার্সের সূত্রগুলো।
হিজবুলস্নাহর প্রধান সমর্থক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী ইরান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দেশে ইরানের মিত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দল এই হিজবুলস্নাহ। তাদের অনেক অস্ত্রই ইরানি, রাশিয়ান বা চীনা মডেলের। বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে রয়টার্সের সূত্রগুলো নাম প্রকাশে রাজি হননি। নতুন আসা অস্ত্রগুলো সম্পর্কে বা কোথা থেকে কেনা হয়েছে, সে বিষয়েও বিস্তারিত কিছু জানাননি সূত্রগুলো। হিজবুলস্নাহর মিডিয়া অফিসও এই প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করতে রয়টার্সের অনুরোধের জবাব দেয়নি।
'কিংস কলেজ লন্ডন'র 'স্কুল অব সিকিউরিটি স্টাডিজ'র একজন জ্যেষ্ঠ লেকচারার আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেছেন, গত সপ্তাহের হামলায় হিজবুলস্নাহর কার্যক্রম ব্যাহত হলেও নেটওয়ার্কভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো এটিকে একটি অত্যন্ত স্থিতিশীল শক্তিতে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, 'সংখ্যা এবং প্রযুক্তি বিবেচনায় নয়, বরং স্থিতিশীলতা বিবেচনায় ইসরাইলের যুদ্ধক্ষেত্রে তার সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রম্নর মুখোমুখি হয়েছে।'
শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র
চলতি সপ্তাহে ইসরাইল-হিজবুলস্নাহ সংঘাদ বেড়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ইসরাইল হিজবুলস্নাহর আরেক শীর্ষ কমান্ডার ইব্রাহিম কুবাইসিকে হত্যা করেছে। তারপরও হিজবুলস্নাহ অপারেশন চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে। এত হামলা সত্ত্বেও ইসরাইলের গভীরে শত শত রকেট নিক্ষেপ করেছে।
গত বুধবার হিজবুলস্নাহ জানিয়েছে, সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিবের কাছে একটি ইসরাইলি গোয়েন্দা ঘাঁটি লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তেল আবিবে একটি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাধা দেওয়ায় সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে উঠেছিল।
হিজবুলস্নাহর সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটগুলোর মধ্যে কোনটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তা এখনো জানায়নি গোষ্ঠীটি। হিজবুলস্নাহর কাছে ইরান নির্মিত 'ফাতেহ-১১০' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার রেঞ্জ (পালস্না) ২৫০-৩০০ কিলোমিটার। ওয়াশিংটনের 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ'র ২০১৮ সালের একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, হিজবুলস্নাহর ফাতেহ-১১০ ক্ষেপণাস্ত্রের ৪৫০-৫০০ কেজি ওয়ারহেড বহনের সক্ষমতা রয়েছে।
এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা দাবি করেছেন, পেজার ও রেডিও বিস্ফোরিত হওয়ার পরও হিজবুলস্নাহর রকেট হামলা চালাতে সক্ষম হওয়াটাই প্রমাণ করে, গ্রম্নপটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখেও 'চেইন অব কমান্ড' বজায় রেখে কাজ করতে পারছে।
ফিক্সড-লাইন টেলিফোন নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে। অনেক যোদ্ধা পেজারের পুরনো মডেল বহন করছিলেন, ফলে গত সপ্তাহের আক্রমণে তাদেরও কোনো ক্ষতি হয়নি।
রয়টার্স এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বলে জানিয়েছে। বিস্ফোরিত পেজারগুলোর বেশিরভাগ আঘাত করেছে বৈরুতে; যা মূল ফ্রন্টলাইন থেকে অনেক দূরে। ইসরাইলের হামলায় কয়েকজন কমান্ডার নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় হিজবুলস্নাহ ফেব্রম্নয়ারিতে যোদ্ধাদের সেলফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পেজার ব্যবহার বাড়িয়েছিল।
হিজবুলস্নাহর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেলেও সীমান্তের কাছে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছোট, স্বাধীন গ্রম্নপে কাজ করার জন্য ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা স্বাধীনভাবেই দীর্ঘসময়ের জন্য ইসরাইলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম বলেও জানিয়েছেন সূত্রটি।
২০০৬ সালে হিজবুলস্নাহ ও ইসরাইলের মধ্যে সবশেষ যুদ্ধের সময় এমন ঘটনা ঘটেছিল। ইসরাইলের হামলার মুখেও কয়েক সপ্তাহ ধরে গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তের গ্রামগুলোয় যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল।
মাটির নিচে ক্ষেপণাস্ত্র
দুটি সূত্র বলেছে, হিজবুলস্নাহ বেশ ভালোভাবেই তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। গত রোববার দক্ষিণ লেবাননের এমন এলাকা থেকে রকেট ছোড়া হয়েছিল, যেখানে তার কিছুক্ষণ আগেই ইসরাইল হামলা চালিয়েছিল।
হিজবুলস্নাহর একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার রয়েছে বলে মনে করা হয় এবং গত মাসে প্রকাশিত এক ফুটেজে দেখা যায়, হিজবুলস্নাহর যোদ্ধারা রকেট লঞ্চার নিয়ে টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রাক চালাচ্ছেন। রোববার ছোড়া রকেটগুলো ভূগর্ভ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কি না সেটি অবশ্য রয়টার্সের সূত্র জানাতে পারেনি।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত বলেছেন, সোমবারের হামলায় হিজবুলস্নাহর হাজার হাজার রকেট ও যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস হয়েছে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলেছে, দূরপালস্নার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ১০০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম ওয়ারহেডসহ রকেট, স্বল্প পালস্নার রকেট এবং বিস্ফোরক ইউএভি সোমবারের আঘাতে ধ্বংস হয়েছে।
তবে ইসরাইলের এই দাবির সত্যতাও রয়টার্স স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। মার্কিন কংগ্রেসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী হিজবুলস্নাহর অস্ত্রাগারে প্রায় দেড় লাখ রকেট রয়েছে। সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দূরপালস্নার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মাটির নিচেই রাখা হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তথ্যসূত্র : ডিডাবিস্নউ নিউজ, রয়টার্স